উপজেলা পরিষদ নির্বাচন-২০২৪ (১ম ধাপ)

স্থানীয় নির্বাচনে প্রার্থীদের অনেকের আয়-সম্পদের অবিশ্বাস্য বিকাশ; ৫৬ শতাংশই ব্যবসায়ী: টিআইবি

সংবাদ বিজ্ঞপ্তি

ঢাকা, ০৬ মে ২০২৪: স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ব্যবসায়ীদের দাপট বাড়ছে, অনেকেরই অবিশ্বাস্য হারে আয় ও সম্পদের বিকাশ ঘটেছে, ফলে জনস্বার্থ থেকে বিচ্যুত হয়ে ব্যক্তিস্বার্থ বা মুনাফাকেন্দ্রিক রাজনীতি প্রাধান্য পাচ্ছে। ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন-২০২৪ (১ম ধাপ) এর প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এমন মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটির পক্ষ থেকে আরো বলা হয়, স্থানীয় পর্যায়েও এখন জনস্বার্থ উপেক্ষা করে নির্বাচনকে বিনিয়োগ হিসেবে দেখার প্রবণতা তৈরি হয়েছে।

প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে টিআইবি দেখিয়েছে, জাতীয় নির্বাচনের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ব্যবসায়ী প্রার্থীদের দাপট বেড়েই চলেছে। ব্যবসায়ী প্রার্থীদের সংখ্যা চতুর্থ নির্বাচনের তুলনায় ৮ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৬ শতাংশ। চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৬৯.৮৬ শতাংশ, ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের প্রায় ৬৬.৫৯ শতাংশ এবং নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ২৪.৩৭ শতাংশের পেশা ব্যবসা। আবার গৃহিণী/ গৃহস্থালীকে পেশা হিসেবে দেখানো প্রার্থীদের সাড়ে ১৯ শতাংশের আয় আসে ব্যবসা থেকে।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের দেশে রাজনীতি ও জনপ্রতিনিধিত্ব ক্ষমতাকেন্দ্রিক। জনস্বার্থ নয় বরং ব্যক্তিস্বার্থ প্রাধান্য পাচ্ছে। আবার দলীয় শৃঙ্খলা, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা কিংবা দলের নীতিগত সিদ্ধান্ত মেনে চলার মতো যে ধরনের আচরণ রাজনৈতিক দলের মতো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রত্যাশিত, তা ক্ষমতার রাজনীতির কাছে জিম্মি হয়ে গেছে। যেহেতু ক্ষমতায় যেতে পারলে সম্পদ বিকাশের সীমাহীন সুযোগ তৈরি হয়, আর ক্ষমতার বাইরে থাকলে এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে হয়, ফলে একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, ব্যবসায়ীরা যেরূপ আগ্রাসীভাবে রাজনীতিতে আসছেন, তারা কি সুস্থ বা যথাযথ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় আসছেন কি-না। যে সকল রাজনীতিবিদরা এরূপ প্রতিকূল অবস্থায়ও সুস্থ ও জনকল্যাণমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি চর্চায় আগ্রহী, তারা প্রায় বিলুপ্ত বা ক্ষমতার রাজনীতিতে তারা কোনঠাসা। নির্বাচন হবে, হচ্ছে, তবে বাস্তবে জনগণের জনস্বার্থকে প্রাধান্য দেয় এমন নির্বাচন কতটুকু হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।’

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ ও ড্যাশবোর্ড প্রস্তুত করেছে টিআইবি। উপজেলা নির্বাচনের ১ম ধাপের প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে টিআইবি দেখিয়েছে, অস্থাবর সম্পদ বৃদ্ধির হারে সংসদ সদস্যদের পেছনে ফেলেছেন উপজেলা পরিষদের জনপ্রতিনিধিরা। ৫ বছরে সংসদ সদস্যদের অস্থাবর সম্পদ বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ছিলো তিন হাজার ৬৫ শতাংশ। সেখানে একটি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের সম্পদ বেড়েছে ৪ হাজার ২০০ শতাংশের বেশি। একইভাবে, ৫ বছরে একজন চেয়ারম্যানের আয় বেড়েছে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৩১৯ শতাংশ, ১০ বছরে এই বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ১৮ হাজার ২৩৩ শতাংশ। অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে সর্বোচ্চ ৪ হাজার ২৫১ শতাংশ, স্ত্রী ও নির্ভরশীলদের সম্পদ বৃদ্ধির সর্বোচ্চ হার ১২ হাজার ৪০০ শতাংশ।

স্থানীয় নির্বাচনের হলফনামা বিশ্লেষণে প্রাপ্ত ফলাফলকে বিস্ময়কর উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘হলফনামা বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি, অনেক জনপ্রতিনিধির আয় অস্বাভাবিক পরিমাণে বেড়েছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থীদের আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির হার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীদের চেয়েও বেশি। হলফনামায় যথাযথ কিংবা পর্যাপ্ত ও সঠিক তথ্য দেওয়া হয়েছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। কোনো কোনো প্রার্থীর আয় খুবই কম দেখানো হয়েছে, যার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। আবার প্রার্থীদের যাদের আয় ও সম্পদ গগণচুম্বীহারে বৃদ্ধি পেয়েছে বা তাদের নির্ভরশীলদের আয়-সম্পদের যে বিপুল বিকাশ ঘটেছে, বৈধ সূত্রের সঙ্গে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ কি-না এ প্রশ্নও অত্যন্ত যৌক্তিক। বাস্তবতা হলো, প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণের মাধ্যমে জনগণ শুধু তথ্যই জানতে পারছে। তবে তার সত্যতা ও যথার্থতা যেমন দেখতে পারছি না, একইভাবে আইনের প্রয়োগ কিংবা ফল কোনটিই দেখছি না। অথচ, এই হলফনামার সত্যতা ও যথার্থতা নিশ্চিতের দায়িত্ব যাদের সেই নির্বাচন কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং দুর্নীতি দমন কমিশন স্বপ্রণোদিতভাবে খতিয়ে দেখার দায়িত্বটি পালন করছে না, যা হতাশাজনক।’

হলফনামা বিশ্লেষণে আরো দেখা যায়, আইনি সীমা অর্থাৎ ১০০ বিঘা বা ৩৩ একর এর বেশি জমি আছে কমপক্ষে ৮ জন প্রার্থীর। তা ছাড়া, ২৩.৪১ শতাংশ প্রার্থীর ঋণ/দায় রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ/দায় রয়েছে ১৫২৮ কোটি টাকার। বিশ্লেষণে আরো দেখা যায়, প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের ১৬.৬৪ শতাংশ বর্তমানে বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত। অন্যদিকে, অস্থাবর সম্পদের ভিত্তিতে নির্বাচনের প্রথম ধাপের প্রার্থীদের মাত্র ৭ শতাংশ কোটিপতি। বাকি প্রায় ৯ শতাংশ প্রার্থীর সম্পদ কোটি টাকার নিচে। চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের মধ্যে ৯৪ জন কোটিপতি। আগের নির্বাচনের তুলনায় এ সংখ্যা বেড়েছে প্রায় তিনগুণ (৫ম নির্বাচনে ছিলো ৩৭ জন)। ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীর মধ্যে ১৭ জন ও নারী ভাইস চেয়ারম্যানদের মধ্যে ৬ জন কোটিপতি। এছাড়া, চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের মধ্যে বছরে কমপক্ষে ১০ লাখ টাকা আয় করেন এমন প্রার্থীর সংখ্যা ১৯৮ জন, যা মোট প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীর ৩৫.২৩ শতাংশ। যা পাঁচ বছর আগের নির্বাচনের তুলনায় প্রায় আড়াইগুণ। সমপরিমাণ আয় করেন এমন ভাইস চেয়ারম্যান ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী দুই ক্ষেত্রেই সংখ্যা বেড়েছে তিনগুণের কাছাকাছি।

হলফনামা পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ জাতীয় নির্বাচনের তুলনায়ও কম। উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে নারী প্রার্থী আছেন মাত্র ২৫ জন। অন্যদিকে, সার্বিকভাবে প্রার্থীদের ৪০ শতাংশই আয় দেখিয়েছেন সাড়ে তিন লাখ টাকার নিচে। অর্থাৎ করযোগ্য আয় নেই তাদের। সাড়ে ১৬ লাখ টাকার বেশি আয় দেখিয়েছেন মাত্র ১০ শতাংশ প্রার্থী। প্রায় ৯৩ শতাংশ প্রার্থীর সম্পদ কোটি টাকার নিচে, বাকি ৭ শতাংশ প্রার্থীর সম্পদ কোটি টাকার বেশি।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক ও গবেষণা দলের প্রধান মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, গবেষণা দলের সদস্য ও আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট কোঅর্ডিনেটর রিফাত রহমান, কে. এম. রফিকুল আলম ও ইকরামুল হক ইভান। চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ১৪৪টি উপজেলার প্রায় ৪৮০০ টি হলফনামায় দেওয়া আটটি তথ্যের বহুমাত্রিক ও তুলনামূলক বিশ্লেষণ, সার্বিকচিত্র, উপজেলাভিত্তিক তুলনা টিআইবির ওয়েবসাইটে “হলফনামায় প্রার্থী পরিচিতি” ড্যাশবোর্ডে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে।

ড্যাশবোর্ডের লিংক- https://www.ti-bangladesh.org/kyc

গণমাধ্যম যোগাযোগ:
মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম
পরিচালক, আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন
মোবাইল: ০১৭১৩-১০৭৮৬৮
ই-মেইল: tauhidul@ti-bangladesh.org

Read in English

Astounding growth of income and assets of candidates in local govt. elections; 56% of them businessmen: TIB


Press Release