সংবাদ বিজ্ঞপ্তি
ঢাকা, ০২ ডিসেম্বর ২০২৫: সরকার কর্তৃক গৃহীত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে সুবিধাভোগী হওয়ার ক্ষেত্রে সমতল ও পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসীরা অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার হচ্ছে। বিভিন্ন ভাতাভিত্তিক ও পণ্যভিত্তিক কর্মসূচিতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে এককালীন সর্বনিন্ম ৫০০ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পর্যন্তু ঘুষ দিতে হয়। এ ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে আদিবাসীদের বরাদ্দ হ্রাস, আইনি ও নীতিকাঠামোগত ঘাটতি, প্রত্যাশিত পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত না হওয়া, চাহিদা ও জনসংখ্যাভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ না করা এবং উপকারভোগী তালিকা প্রণয়ণে স্বচ্ছতার ঘাটতি বিদ্যমান। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) পরিচালিত “সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়” শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
আজ টিআইবির ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে আদিবাসীদের কাছ থেকে ঘুষ আদায়ে জড়িত রয়েছে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য, চেয়ারম্যান, গ্রাম পুলিশ, উপজেলা সমাজসসেবা অফিসের কর্মকর্তাসহ আরোও অনেকে। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা, নির্বাহী-ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের ও মুহাম্মদ বদিউজ্জামান, পরিচালক, রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি। সংবাদ সম্মেলনটি পরিচালনা করেন মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম, পরিচালক, আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন রাজিয়া সুলতানা, রিসার্চ ফেলো, টিআইবি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘শান্তি প্রতিষ্ঠার অন্যতম পূর্বশর্ত বৈষম্য দূর করা ও সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর ন্যায্য অধিকার প্রাপ্তি নিশ্চিত করা। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে সমতল ও পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ন্যায্য অধিকার বিবেচনায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতায় তাদের ন্যায্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘গবেষণার সাতটি নির্দেশকের প্রতিটিতেই সুশাসন ও স্বচ্ছতার ঘাটতি এবং দুর্নীতি ও অনিয়মের উদ্বেগজনক চিত্র প্রকাশিত হয়েছে। এ থেকে সুস্পষ্ট যে আদিবাসীদের ন্যায্য প্রাপ্য রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে পারছে না। বৈষম্যহীন ও শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার অন্যতম পূর্বশর্ত সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা, এবং সে লক্ষে সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তার যে মূল ধারা তার মধ্যে আদিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। আদিবাসীরা অনিয়ম-দুর্নীতির চক্রে আবর্তিত হচ্ছে। এ চিত্র আমাদের প্রতিহত করতে হবে। নীতিকাঠামো ও আইনি দুর্বলতার কারণে সরকারের পক্ষ থেকে যে অঙ্গীকার তাও বাস্তবায়িত হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামে কৌশলগত প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়ন, যা সরকারের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অংশ ছিলো এবং একইভাবে সমতলের আদিবাসীদের জন্য আলাদা ভূমি কমিশন গঠনের ঘোষণাও বাস্তবায়িত হয়নি। অনতিবিলম্বে সরকারের নিজের করা এই অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন করতে হবে।’
আদিবাসী জনগোষ্ঠী প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যেও প্রান্তিক পর্যায়ে অবস্থান করছে। আর এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে যে কর্মসূচীগুলো পরিচালিত হচ্ছে, সেগুলোতে প্রান্তিক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সমস্যার প্রতি অধিকারভিত্তিক সংবেদনশীলতার ঘাটতি রয়েছে উল্লেখ করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে একধরনের সংখ্যাগরিষ্ঠতন্ত্র বিদ্যমান। যার ফলে আদিবাসীদের ন্যায্য পাওনা ও অধিকার উপলব্ধি বা স্বীকৃতি আমরা দেখতে পাচ্ছি না। ‘‘আমরা ও তারা’’ এই সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে যে বৈষম্য, তা শুধু আদিবাসীদের প্রতি সীমাবদ্ধ নয়, ধর্মীয়, জেন্ডার, জাতিগত ও সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিচয়সহ বিভিন্ন মানদ-ে সকল ক্ষেত্রেই তার বলপূর্বক চর্চার প্রতিফলন ঘটছে। আদিবাসীদের ‘‘আদিবাসী’’ হিসেবে আত্মপরিচয়ের অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ যত দ্রুত সম্ভব আইএলও কনভেনশন ১৬৯-এ বাংলাদেশের স্বাক্ষর করার দাবি জানাচ্ছি। তাতে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে রাষ্ট্রের অঙ্গীকারের প্রতিফলন ঘটবে । আদিবাসীদের অধিকারের দাবি শুধু আদিবাসীদের নয়, বাংলাদেশের সকল নাগরিকের দাবি। আমরা যদি সমঅধিকারভিত্তিক সম্প্রীতি ও সহ-অবস্থানের সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাই, তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠতান্ত্রিকভাবে কোনো বিশেষ শ্রেণীর ওপর বৈষম্য চাপিয়ে সম্ভব নয়।’
গবেষণায় ভাতাভিত্তিক কর্মসূচি ও পণ্যভিত্তিক কর্মসূচিতে যে সকল অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে তার মধ্যে বয়স্কভাতা (আজীবন) কর্মসূচিতে দেখাগেছে, বয়স্ক ভাতার (আজীবন) জন্য সমতলের আদিবাসীদের ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা এককালীন ঘুষ দিতে হয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের ২ হাজার ৫ শত থেকে ৬ হাজার টাকা। একইভাবে, ভাতাভিত্তিক কর্মসূচি ভিডব্লিউবি-এর জন্য সমতলের আদিবাসীদের এককালীন ঘুষ দিতে হয় ২ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা এবং পার্বত্য আদিবাসীদের ২ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা।
গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী আর্থিক বরাদ্দের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, জিডিপিতে সামাজিক নিরাপত্তা বাজেটের হার ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে ২০২৫-২৬ অর্থবছর পর্যন্ত ক্রমান¦য়ে কমেছে। একইভাবে আইএলও কনভেনশন -এ ‘‘আদিবাসী’’ পরিচয় ও প্রথাগত ভূমি-অধিকারের স্বীকৃতি থাকলেও বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর করেনি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তিতে (১৯৯৭) আংশিকভাবে আদিবাসীদের ভূমি-অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে। জাতীয় আইনে আদিবাসীদের প্রথাগত ভূমি-স্বত্বের স্বীকৃতি অনুপস্থিত। বাংলাদেশ অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০২০-২০২৫) শুধু পার্বত্য অঞ্চলের সমস্যা চিহ্নিত করে, কিন্তু সমতলের আদিবাসীদের নয়। সমতলের আদিবাসীদের জন্য ‘ভূমি কমিশন’ গঠিত না হওয়ায় আদিবাসীদের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ভূমি হারিয়েছে ও উচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। অন্যদিকে পার্বত্য অঞ্চলে ইউনিয়নের সংখ্যা কম হলেও দুর্গমতা ও ভৌগোলিক প্রতিবন্ধকতা বিবেচনা না করে স্বল্প সংখ্যক জনবল দিয়ে তালিকা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। গবেষণায় কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে আদিবাসী প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় পরিকল্পনায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর চাহিদা এবং ভৌগোলিক বৈচিত্র্য বিবেচনা না করে একই কাঠামোর অধীন নীতিমালা এবং প্রকল্প নকশা প্রণয়ন করা হয়। প্রাথমিক বাছাই কমিটিতে আদিবাসী প্রতিনিধি, হেডম্যান, কারবারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। এছাড়া, বেশিরভাগ কর্মসূচির ক্ষেত্রে ভৌগোলিক প্রতিবন্ধকতার কারণে পর্যাপ্ত মাইকিং করা হয় না। অনলাইনে আবেদনের ক্ষেত্রে দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে ইন্টারনেট, বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় আবেদন বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। গবেষণায় আরো দেখা গেছে, পাঁচটি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে আদিবাসীদের মধ্যে সুবিধা পাওয়ার যোগ্য জনসংখ্যার তুলনায় আবেদনকারী ও তাদের মধ্যে নির্বাচিতের গড় হার ১৯.৭ শতাংশ। গবেষণার আওতাভুক্ত ২২টি ইউনিয়ন পরিষদের ওয়েবসাইটে বেশিরভাগ কর্মসূচির সুবিধাভোগীর তালিকা ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির প্রয়োজনীয় তথ্য প্রকাশ করা হয়নি, থাকলেও তথ্য হালনাগাদ ছিলো না। দলীয় সমর্থকদের বাছাই, ভোটের প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে ভাতাভোগী নির্বাচন; যোগ্য হলেও বিরোধী দলের কর্মী বা সমর্থকদের তালিকাভুক্ত করা হয় না। জীবিত ভাতাভোগীকে মৃত দেখিয়ে অন্যজনকে নির্বাচনের অভিযোগ পাওয়া যায়।
আদিবাসী বিষয়ক সমস্যাসমূহ উত্তরণে, গবেষেণায় মোট ১৪টি সুপারিশ করা হয়। এদের মধ্যে রয়েছে: আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের ন্যায্য প্রাপ্য অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানে আইএলও কনভেনশন ১৬৯ অনুস্বাক্ষর করতে হবে; সব কর্মসূচির বাস্তবায়ন নীতিমালায় আদিবাসীদের অগ্রাধিকার সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় সুনির্দিষ্ট বাজেট বরাদ্দ করতে হবে; আদিবাসীদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আবেদন প্রক্রিয়া, জন্মনিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র প্রাপ্তি ও সংশোধন প্রক্রিয়া এবং অন্যান্য নথি প্রাপ্তি সহজ ও আদিবাসীবান্ধব করতে হবে।
গুণগত পদ্ধতি নির্ভর গবেষণাটির সময়কাল জুন ২০২৪ থেকে নভেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত। গবেষণায় আদিবাসী সম্প্রদায়ের সংখ্যা ও ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় দেশের আটটি বিভাগ থেকে ১১টি জেলা নির্বাচন করা হয়েছে, যার মধ্যে আটটি সমতল এবং তিনটি পার্বত্য এলাকায় অবস্থিত। গবেষণায় মোট ২৯টি সম্প্রদায় (সমতলের ২২টি ও পার্বত্য এলাকার ০৭টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
গবেষণা সংক্রান্ত নথিপত্র : https://www.ti-bangladesh.org/articles/research/7390
গণমাধ্যম যোগাযোগ:
মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম
পরিচালক, আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন
মোবাইল: ০১৭১৩-১০৭৮৬৮
ই-মেইল: tauhidul@ti-bangladesh.org