মানিকগঞ্জে বাউলদের ওপর হামলা

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যবিরোধী শক্তির অশুভ বিকাশরোধে সরকার নীরব কেন? : টিআইবি

সংবাদ বিজ্ঞপ্তি

ঢাকা, ২৪ নভেম্বর ২০২৫: মানিকগঞ্জে বাউল শিল্পী আবুল সরকারের গ্রেপ্তার এবং তাঁর সমর্থকদের ওপর শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন চলাকালে সংঘটিত সমন্বিত মব-হামলা দেশব্যাপী ধর্মীয় সহাবস্থান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যবিরোধী শক্তির ক্রমবর্ধমান বিকাশ, ধর্মান্ধতা ও সংখ্যাগুরুতান্ত্রিক অসহিষ্ণুতার বিপজ্জনক বিস্তৃতির উদ্বেগজনক উদাহরণ। এ ধরনের ঘটনা দেশের ধর্মীয় ও সামাজিক, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও সর্বোপরি মৌলিক মানবাধিকারের প্রতি চরম হুমকি বলে মন্তব্য করেছে করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে শিল্পীকে দ্রুত গ্রেপ্তার করা হলেও, প্রকাশ্য দিবালোকে সংগঠিত হামলা থেকে আহত বাউল শিল্পীদের রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয় পর্যবেক্ষকের ভূমিকা ও এ প্রসঙ্গে সরকারের নীরবতা আইনের শাসন, মানবাধিকার, মত প্রকাশ ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের সাংবিধানিক অধিকারকে পদদলিত করেছে।

বিষয়টিকে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা হিসেবে দেখানোর সুযোগ নেই উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ’অবস্থাদৃষ্টে এমন মনে হওয়া অমূলক নয় যে এ ঘটনা একটি সুসংগঠিত কৌশলের অংশ। দেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, লোকঐতিহ্য, আধ্যাত্মিক অনুশীলন এবং সংখ্যালঘু বিশ্বাসের ওপর চাপ বিভিন্ন সময়ে সামনে এসেছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, গত বছর কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের পর এ প্রবণতা ব্যাপকভাবে বেড়ে চলেছে। স্থানীয়ভাবে ধর্মান্ধতানির্ভর আক্রমণাত্মক ব্যানারের পেছনে সক্রিয় শক্তিগুলো কার্যত ধর্মীয় বৈচিত্র্য, গোষ্ঠীগত ভিন্নমত, সাংস্কৃতিক বহুত্ব, লোকায়ত ও আধ্যাত্মিক বৈচিত্র্যকে দমন করার উগ্র মিশন চালাচ্ছে। বিভিন্ন জেলায় মাজার ভাঙচুর, কবর থেকে মৃত পীরের দেহ উত্তোলন ও অগ্নিসংযোগ, বাউল আসর বন্ধ, বাদ্যযন্ত্র জব্দ, গ্রামীণ মেলা, নাটক বন্ধ করা, ভিন্নমতের প্রকাশ্য হেনস্তার মতো ঘটনা নিয়মে পরিণত হয়েছে। সরকার নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে ধর্মান্ধ, উগ্র ও অশোভন তৎপরতার প্রতি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। কেন- এ প্রশ্নের যেমন জবাব পাওয়া যায়নি, তেমনি ধর্মান্ধ মহলের উগ্র চাপের মুখে সরকারি প্রাথমিক স্কুলে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত কেন বাতিল করে এ ধরনের অপশক্তির কাছে আত্মসমর্পন করলো, তারও কোনো সদুত্তর নেই। এর মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে, সরকারের নীরবতা এবং দুর্বল আইনপ্রয়োগ একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী তাদের জন্য রাষ্ট্রীয় তোষণ হিসেবে ব্যবহার করছে। এমতাবস্থায়, অবিলম্বে বাউলদের ওপর হামলাকারীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সাংবিধান অঙ্গীকারের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রমাণ রাখতে আহ্বান জানাই আমরা।’

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশ বৈচিত্র্যপূর্ণ লোকায়ত সংস্কৃতি চর্চা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ, ধর্ম ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা বহুমুখী চাপে প্রতিনিয়ত ভূলুন্ঠিত হচ্ছে। মানিকগঞ্জের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওচিত্রে দেখা গেছে, হামলার মুহূর্তে পুলিশ দৃশ্যত অনাগ্রহী ও পর্যবেক্ষক ভূমিকায় অবস্থান করেছে-যা পরিস্থিতিকে আরো গুরুতর করে তোলে। প্রকাশ্য হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর দৃশ্যমান অনীহা ও সরকারের নীরবতাকে গোষ্ঠীগত সহিংসতার একটি অনানুষ্ঠানিক অনুমোদন হিসেবে ব্যাখ্যা করার ঝুঁকি তৈরি করে। এই পরিবেশে শিল্পীরা আত্মগোপনে যাচ্ছেন, পালাগান ও মাজারভিত্তিক সাংস্কৃতিক ধারার অনেকে তাদের কার্যক্রম সংকুচিত করতে বাধ্য হচ্ছেন এবং বৈচিত্র্যময় লোকসংস্কৃতির অনুশীলন এখন ভীতির সংস্কৃতির মুখে পড়ছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সংস্কৃতি অনুশীলন ও চর্চার স্বাধীনতা নিয়ে সংশয়ে ভুগছেন। ধর্মীয় বৈচিত্র্য, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকারের সুরক্ষা রাষ্ট্রের কর্তব্য- এ সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি এখন কার্যত চ্যালেঞ্জের মুখে। ধর্মীয় অনুভ‚তির ওপর আঘাতের নামে আইনের অপব্যবহার কর্তৃত্ববাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিলো। “নতুন বাংলাদেশ”-এ তারই ধারাবাহিকতায় অধিকতর উদ্বেগ তৈরি করছে; কিন্তু শুরু থেকেই সরকার এ সকল অপতৎপরতার প্রতিরোধে স্বচ্ছ অবস্থান বা ভূমিকা গ্রহণ করতে ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এর ফলে একদিকে ধর্মান্ধতা ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হয়েছে, অন্যদিকে শান্তিপূর্ণ ধর্ম চর্চা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও স্বাধীনতা হরণ হয়েছে। উগ্রতাকে রাষ্ট্রীয় তোষণের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিকীকরনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।’

শুধু মানিকগঞ্জে বাউলদের ওপর হামলা নয়, সাম্প্রতিক সময়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণাপূর্ণ ঘোষণা এবং তার সঙ্গে মূলধারার রাজনীতির একাত্মতা, ভীতি সৃষ্টিকারী সমাবেশ এবং ধর্মীয় বৈরিতা উসকে দেওয়া বয়ান-এ সবই ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের বিরুদ্ধে সংগঠিত বৈরিতার বিস্তৃতিকে নির্দেশ করে উল্লেখ করে ড. জামান বলেন, ‘রাষ্ট্রের দ্রুততম পদক্ষেপটি যখন একজন শিল্পীর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়, অথচ প্রকাশ্য সহিংসতার বিরুদ্ধে বিন্দুমাত্র দৃঢ়তা অনুপস্থিত থাকে, তখন রাষ্ট্র আসলে কী বার্তা দেয়? সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বৈচিত্র্যের ওপর আক্রমণকারী শক্তির সামনে রাষ্ট্র ভীত, অপারগ না-কি পরিকল্পিতভাবে প্রশ্রয় দিচ্ছে- এমন প্রশ্ন ওঠাও অমূলক নয়।

ভিন্নমত, সংস্কৃতি বা বিশ্বাসের প্রতিনিয়ত অসহিষ্ণুতা, ঘৃণা, আক্রমণের বিপরীতে রাষ্ট্রীয় নিষ্ক্রিয়তার কারণে একদিকে যেমন তা সামাজিক বাস্তবতায় রূপান্তরিত হচ্ছে, অন্যদিকে রক্তক্ষয়ী বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে সূচিত “নতুন বাংলাদেশ”-এর মানবাধিকার, সংখ্যালঘু সুরক্ষা এবং সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতিও প্রতিনিয়ত পদদলিত হচ্ছে। মব-ভায়োলেন্স, ধর্মীয় উসকানি এবং ভিন্নমত, সংস্কৃতি বা ধর্মীয় বিশ্বাস দমনের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান ও কঠোর পদক্ষেপ নিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আহ্বান জানাই। আমরা মনে করিয়ে দিতে চাই, এ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে ব্যর্থ হলে তা “নতুন বাংলাদেশ”-এর প্রতিশ্রুত ধর্মীয় সহাবস্থান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সাংস্কৃতিক সহনশীলতা এবং নাগরিক স্বাধীনতা ধূলিসাৎ হবে, নতুন রূপে কর্তৃত্ববাদের বিকাশের ঝুঁকি সৃষ্টি করবে।’

গণমাধ্যম যোগাযোগ:
মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম
পরিচালক, আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন
মোবাইল: ০১৭১৩-১০৭৮৬৮
ই-মেইল: tauhidul@ti-bangladesh.org

Read in English

Attack on Bauls in Manikganj: Why Does the Government Remain Silent While Threats to Communal Harmony and Cultural Diversity Intensify Alarmingly? – TIB


Press Release