ঢাকা, ৯ অগাস্ট ২০১৫: নবম ও দশম জাতীয় সংসদে প্রথম অধিবেশনে সব কমিটি গঠন ও দশম সংসদে দলীয় প্রতিনিধিত্বের অনুপাতে সদস্য নিযুক্তির ক্ষেত্রে ইতিবাচক পদক্ষেপ গৃহীত হলেও আইনগত, প্রাতিষ্ঠানিক, রাজনৈতিকসহ বিবিধ চ্যালেঞ্জের কারণে কমিটির ওপর সার্বিকভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়ায় কমিটিগুলো কার্যকর হচ্ছে না বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) কর্তৃক আজ এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
‘বাংলাদেশে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কার্যকরতা: সমস্যা ও উত্তরণের উপায়’ শীষর্ক গবেষণা প্রতিবেদনের সারাংশ উপস্থাপন করে উল্লিখিত অভিমত ব্যক্ত করা হয়। আজ সকালে ধানমণ্ডিস্থ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার জুলিয়েট রোজেটি ও ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফাতেমা আফরোজ। অনুষ্ঠানে আরোও উপস্থিত ছিলেন টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এম হাফিজউদ্দিন খান, নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এবং রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান।
নবম সংসদের পুরো মেয়াদ এবং দশম সংসদের ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত কমিটিগুলোর কার্যক্রম পর্যালোচনা করে টিআইবি বলেছে, রাজনৈতিক বা দলীয় প্রভাব, স্বার্থের দ্বন্দ্ব, সদস্য কর্তৃক বা মন্ত্রণালয় কর্তৃক কমিটিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে না করা, কমিটির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাধ্যবাধকতা না থাকা, এবং হাজিরাস্বাক্ষ্য প্রদান ও দলিলপত্র প্রদানে বাধ্য করার ক্ষেত্রে ক্ষমতা না থাকা ইত্যাদি কারণে বাস্তবে এই কমিটিগুলো প্রত্যাশিত পর্যায়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। প্রতিবেদন অনুযায়ী, কমিটির সদস্য নির্বাচনের সময় তাদের দক্ষতা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, ব্যবসায়িক সংশ্লিষ্টতা ইত্যাদি কিছুই দেখা হয় না এবং কমিটির সভাপতি ও সদস্য নির্বাচন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সরকারি দল এবং দলীয় প্রধানের প্রভাব লক্ষ্যণীয়। সভাপতি নিয়োগে সংসদে দল অনুযায়ী আনুপাতিক হারের তুলনায় বিশ্লেষণে দেখা যায় যে সদস্য হিসেবে নবম সংসদে ১১% ও দশম সংসদে ১৭% বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্ব ছিল এবং সভাপতি হিসেবে যথাক্রমে তা ছিল ৪% ও ২%। নবম সংসদে ১১টি কমিটি মোট ৩১ বার এবং দশম সংসদে তিনটি কমিটি মোট তিনবার পুনর্গঠিত হলেও কমিটি পুনর্গঠনের কোনো কারণ প্রকাশিত হয় নি। এছাড়া মাসে অন্তত একবার বৈঠক করার কথা থাকলেও বেশীরভাগ কমিটিই তা করেনি এবং সদস্য বা সভাপতির বৈঠকে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রেও অনিয়ম দেখা গিয়েছে।
গবেষণার বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বিধি বহির্ভূতভাবে নবম সংসদের ৫১টির মধ্যে ৬টি এবং দশম সংসদের ৫০টির মধ্যে ৫টি কমিটিতে সদস্যের কমিটি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়িক সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গিয়েছে। কেস হিসেবে গৃহীত ১১টি কমিটির মধ্যে ৯টি কমিটির ১৯ জন সদস্যের ব্যবসা সংক্রান্ত সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়া গিয়েছে। কমিটির সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ রয়েছে।
আইনসভার কার্যক্রমে জনগণকে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে কমিটিগুলোর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য নয়। গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যায়, স্থায়ী কমিটির দায়িত্ব থাকলেও নবম ও দশম সংসদে কোনো বিলের জনমত যাচাই-বাছাই করা হয় নি। উল্লিখিত ১১টি কমিটির সুপারিশক্রমে ৭৩টি বিল পাস হয়েছে, যার মধ্যে ৬৯টি বিলে সংসদ সদস্যরা জনমত যাচাই-বাছাইয়ের প্রস্তাব দিলেও ৩৭টি বিলের ক্ষেত্রে প্রস্তাব অধিবেশনেই কণ্ঠভোটে নাকচ হয় এবং ৩২টি বিলের ক্ষেত্রে সদস্য অনুপস্থিত থাকায় প্রস্তাব সংসদের অধিবেশনে উত্থাপিত হয় নি। অনেক ক্ষেত্রে বিধিতে নিষেধাজ্ঞা থাকায় কমিটিগুলো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না।
কমিটির সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের বিশ্লেষণ অনুযায়ী কমিটির সিদ্ধান্তের বড় অংশই বাস্তবায়িত হয় না। কেস হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ১১টি কমিটি নবম সংসদে মোট ১,৮৯১টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল যার মধ্যে ৪১% বাস্তবায়িত হয়, এবং নবম সংসদ শেষ হওয়া পর্যন্ত বাস্তবায়নাধীন ছিল ২০%। গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহের মধ্যে দুর্নীতি সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত তুলনামূলকভাবে কম (৪%) ছিল। এ ধরনের সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব যেমন লক্ষ্যণীয় তেমনি জবাবদিহিতার পরিবর্তে দুর্নীতির সাথে জড়িত ব্যক্তিকে রক্ষায় কাজ করার এবং তদন্তে দুর্নীতি প্রমাণিত হলেও তার ভিত্তিতে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। সেইসাথে কমিটির কার্যক্রমে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশের ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া কমিটির কার্যক্রমে জনগণের সম্পৃক্ততা খুবই সীমিত পর্যায়ের। কমিটির কার্যক্রমের মূল্যায়ন কাঠামোরও কোনো অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায় না।
সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “সংসদীয় কমিটিগুলোকে কার্যকর করতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নানা ইতিবাচক দৃষ্টান্ত রয়েছে। যুক্তরাজ্য ও প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে আইনসভায় প্রতিনিধিত্বের সমানুপাতিক হারে কমিটিতে সদস্য ও সভাপতি করা হয় এবং মন্ত্রী কমিটির সভাপতি বা সদস্য হন না। আর্থিক কমিটিগুলোর সভাপতি বিরোধী দল থেকে নির্বাচন করা হয়। এ রকম ভালো উদাহরণগুলো আমাদের দেশে চর্চা করা হলে কমিটিগুলো প্রত্যাশিত পর্যায়ে কার্যকর হওয়ার সুযোগের সৃষ্টি হবে।’’
নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সংসদীয় কমিটিগুলোকে কার্যকর করতে টিআইবি’র গবেষণায় উত্থাপিত সুপারিশসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: সংবিধানের ৭৬ (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করে সাক্ষী হাজিরা, সাক্ষ্য প্রদান এবং দলিলপত্র দেওয়ায় বাধ্য করার ক্ষমতা কমিটিকে দেয়া; সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি সংশোধন করে সভাপতি ও সদস্যদের বাণিজ্যিক, আর্থিক সম্পৃক্ততার তথ্য প্রতিবছর হালনাগাদ করে তা জনসম্মুখে প্রকাশ বাধ্যতামূলক করার বিধান করা; এবং আর্থিক কমিটিগুলোতে বিরোধী দলের মধ্য থেকে সভাপতি নির্বাচন করা অন্যতম। এছাড়াও প্রাক-বাজেট আলোচনার জন্য অর্থবিল অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত তথ্য কমিটিতে প্রেরণ করা; কমিটির সুপারিশের আলোকে মন্ত্রণালয়ের গৃহীত ব্যবস্থা সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার তিনমাসের মধ্যে লিখিতভাবে কমিটিকে জানানো বাধ্যতামূলক করা এবং কমিটির প্রতিটি সভার কার্যবিবরণী সভা-পরবর্তী দুই সপ্তাহের মধ্যে এবং পূর্ণাঙ্গ বার্ষিক প্রতিবেদন প্রতিবছর সংসদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার পরামর্শ দিয়েছে টিআইবি।
গণমাধ্যম যোগাযোগ:
পরিচালক
আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন
ফোন: +৮৮ ০২ ৪১০২১২৬৭-৭০