দুর্নীতি দমন কমিশনকে পরিপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা প্রদানের দাবি
ঢাকা, ৯ জুন ২০১৩:বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর সাফল্য অর্জন করতে হলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-কে পরিপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দিতে হবে। দুদকের বাজেটকে সরকারের দায়মুক্ত তহবিলে অন্তর্ভুক্ত করে এর পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করণের লক্ষ্যে অবিলম্বে সংসদে বিবেচনাধীন দুদক খসড়া সংশোধনী আইনটি প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের মতামতের ভিত্তিতে তা অনুমোদনের উদ্যোগ নিতে হবে। দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে স্বাধীন, শক্তিশালী দুদকের ভূমিকার কোন বিকল্প নেই। স্বাধীন ও শক্তিশালী দুদকের পাশাপাশি জাতিসংঘ দুর্নীবিরোধী সনদের আলোকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন ও সংস্কারসহ প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত পরিবর্তন অব্যাহত রাখতে হবে। জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে অনুষ্ঠিত ‘জাতিসংঘ দুর্নীতিবিরোধী সনদ বাস্তবায়নে বাংলাদেশের অগ্রগতি’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এই অভিমত ব্যক্ত করেন।
আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর চেয়ারম্যান জনাব গোলাম রহমান এবং তথ্য কমিশনের প্রধান তথ্য কমিশনার প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ফারুক উপস্থিত ছিলেন। এতে সভাপতিত্ব করেন টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
গোলটেবিল বৈঠকে জাতিসংঘ দুর্নীতিবিরোধী সনদ বাস্তবায়নে বাংলাদেশের উদ্যোগ, সাফল্য, ব্যর্থতা, চ্যালেঞ্জ ও সার্বিক অগ্রগতি পর্যালোচনাপূর্বক একটি প্রতিবেদনের সারাংশ উপস্থাপন করেন টিআইবি’র গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাম্মী লায়লা ইসলাম। প্রতিবেদনে দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধ; অপরাধ নির্ধারণ ও আইনের প্রয়োগ; বিচার বিভাগের স্বাধীনতা; সম্পদ পুনরুদ্ধার এবং রাজনৈতিক দলের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বিষয়ে পর্যালোচনা করা হয়।
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ তাঁর বক্তব্যে বলেন, “দুর্নীতি থামাতে হলে সর্বস্তরের মানুষকে দুর্নীতিকে না বলতে হবে। সরকার দুর্নীতি কমানোর জন্য তথ্য সরবরাহকারীর সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করেছে। এ আইনের মাধ্যমে যে কোন সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারি দুর্নীতি সম্পর্কে যে কোন তথ্য প্রকাশ করে দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজ করতে পারে। তথ্য প্রদানকারীকে সুরক্ষার জন্যই এ আইন করা হয়েছে।”
দুদক চেয়ারম্যান জনাব গোলাম রহমান তাঁর বক্তব্যে বলেন, “দুদকের যাবতীয় নিয়োগ ও পদায়ন স্বচ্ছতা ও আইনানুগভাবে হয়েছে। ”
টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “আইন ও নীতিমালার পরিবর্তন এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে যে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব একথা আজ বৈশ্বিক অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত। জাতিসংঘ দুর্নীতিবিরোধী সনদের আলোকে এ পর্যন্ত গৃহিত সরকারি পদক্ষেপসমূহ প্রশংসনীয় হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত। টিআইবি জনগণের মধ্যে দুর্নীতিবিরোধী চাহিদা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।” রাজনৈতিক অঙ্গীকারের নির্ভেজাল প্রয়োগ ও সর্বদলীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে দুর্নীতিকে কার্যকরভাবে দমন করা সম্ভব বলে তিনি মন্তব্য করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয় বাংলাদেশ জাতিসংঘ দুর্নীবিরোধী সনদ বাস্তবায়নে কমপ্লাইয়েন্স অ্যান্ড গ্যাপ অ্যানালাইসিস (বিসিজিএ), সনদ বাস্তবায়নের জন্য একটি কর্ম-পরিকল্পনা গ্রহণ; তথ্য কমিশন ও মানবাধিকার কমিশন গঠন; জাতিসংঘ দুর্নীতিবিরোধী সনদ সংক্রান্ত সেলফ-অ্যাসেসমেন্ট চেকলিস্ট পূরণ ও জমা দান; জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল প্রণয়ন; সনদের সাথে সংগতি বিধানের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ন ও সংশোধন এর মতো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী দুর্নীতিবিরোধী কর্ম-পরিকল্পনার অধিকাংশ কর্মকাণ্ড ২০০৯ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার কথা থাকলেও অনেক কার্যক্রম উক্ত সময়সীমার মধ্যে সম্পন্ন হয়নি। বাংলাদেশে জাতিসংঘ দুর্নীতিবিরোধী সনদ বাস্তবায়নে যেসব ক্ষেত্রে অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয় নি সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- দুর্নীতি দমন আইনের পর্যালোচনা ও হালনাগাদকরণ; ‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯’ পর্যালোচনা; সিভিল সার্ভিস আইন প্রণয়ন; সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন; এবং সনদ বাস্তবায়নের অগ্রগতির তথ্য একটি জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডার, সুশীল সমাজ ও সাধারণ জনগণকে অবহিতকরণ।
আলোাচনায় অংশ নিয়ে বক্তারা বলেন, দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারি-বেসরকারি নানা পদক্ষেপ সত্ত্বেও দেশে এখনো দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতা উদ্বেগজনক। দুর্নীতি দমন কমিশন এখনও একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বকীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে নি। দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা প্রত্যাশিতভাবে বৃদ্ধি করা হয়নি, বরং আইনি সংস্কারের মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশনকে একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। রাজনৈতিক বিবেচনায় দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহার, এবং কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখার মত পদক্ষেপগুলো দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধের পথে অন্তরায় হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
বিভিন্ন আইনি ও পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে পাচারকৃত অর্থ পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয় না উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয় যে এ বিষয়ে সরকারের দিক থেকে ধারাবাহিক দৃঢ় অবস্থান পরিলক্ষিত হয় না।
নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও নিম্ন আদালতের ওপর প্রশাসনের প্রভাব রয়ে গেছে বলে আলোচকরা অভিমত ব্যক্ত করেন।
রাজনৈতিক দলের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জের উল্লেখ করে বলা হয়- নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে নির্বাচনী ব্যয় পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধানের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া নিরীক্ষা সংক্রান্ত গবেষণায় প্রার্থী ও রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের তথ্য পাওয়া যায়। যথাযথ পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন না হওয়ায় রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীরা খুব কমই নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনজনিত শাস্তির সম্মুখীন হয়েছেন।
গোলটেবিল বৈঠকে টিআইবি’র পক্ষ থেকে ২৫ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: রাজনৈতিক দলের স্বচ্ছ এবং সুসংগঠিত আর্থিক ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন; রাজনৈতিক দলগুলোর তহবিল সংগ্রহ, বাজেট প্রণয়ন ও আয়-ব্যয়ের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন।