সংবাদ বিজ্ঞপ্তি
রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ঝুঁকি সৃষ্টি:
সমন্বয় ও ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে এবং প্রত্যাবাসনে তের দফা সুপারিশ টিআইবির
ঢাকা, ৫ ডিসেম্বর ২০১৯: রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তার ব্যবস্থাপনা কাঠামোতে সমন্বয়, আন্তঃযোগাযোগ এবং তদারকিতে ঘাটতিসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। বিভিন্ন পর্যায়ে সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর উদ্ভব হওয়ায় মানবিক সহায়তা কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ডেটাবেইজ- এর অনুপস্থিতি ও তথ্য প্রকাশে ঘাটতির কারণে এই মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে স্বচ্ছতার ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। “বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের (রোহিঙ্গা) নাগরিকদের বাংলাদেশে অবস্থান: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়” শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আজ টিআইবির ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এসময় রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা কার্যক্রম সমন্বয় ও ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে এবং রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে তের দফা সুপারিশ প্রদান করে সংস্থাটি। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান, সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম. আকরাম এবং আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলম। গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহ্নুর রহমান এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাজমুল হুদা মিনা।
বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে ১৩ জুলাই ২০১৯ থেকে ৩০ অক্টোবর ২০১৯ সময়ের মধ্যে পরিচালিত এই গবেষণাটির সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য হলোÑ রোহিঙ্গাদের জন্য গৃহীত উদ্যোগ ও এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের কার্যক্রম ও সমন্বয় ব্যবস্থার পর্যালোচনা করা; রোহিঙ্গাদের ত্রাণ ব্যবস্থাপনায় বিদ্যমান সুশাসনের চ্যালেঞ্জ নিরূপণের পাশাপাশি অনিয়ম ও দুর্নীতি চিহ্নিত করা; এবং সার্বিক ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণের উপায় সুপারিশ করা। এই গবেষণায় রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট অংশীজনের কার্যক্রম পর্যালোচনার পাশাপাশি মানবিক সহায়তায় বিশেষত খাদ্য ও পুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন, সুরক্ষা ও নিরাপত্তা পর্যালোচনা করা হয়েছে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অবস্থান এবং তাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হওয়ায় সৃষ্ট ঝুঁকির ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাবের পাশাপাশি রাজনৈতিক ঝুঁকি ও নিরাপত্তা পর্যালোচনা করা হয়েছে।
গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৭ সালে পরিচালিত গবেষণায় টিআইবি রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি নিরূপণ করে তা থেকে উত্তরণে যেসব সুপারিশ করেছিল তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বেশ কয়েকটি ইতিবাচক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনো রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের ঘাটতিসহ নানাবিধ চ্যালেঞ্জ, ঘাটতি ও ঝুঁকি বিদ্যমান।
গবেষণার প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনায় সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে। সরকারি অংশীজনের মধ্যে এনজিও কার্যক্রমের তদারকিতে জেলা প্রশাসন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং আরআরআরসি কার্যালয় একই ভূমিকা পালন করে। এর ফলে এনজিওগুলোর প্রকল্প কার্যক্রম শুরুর অনুমোদন ও ছাড়পত্র পেতে এবং ত্রাণের মান ও পরিমাণ যাচাইয়ে দীর্ঘসূত্রতা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। ডিসি অফিস ও আরআরআরসির মধ্যে তথ্যের আদান প্রদান ও যোগাযোগেরও ঘাটতি রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে ক্যাম্প পর্যায়ে জাতীয়, আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর কাজের পুনরাবৃত্তি ও সমন্বয়হীনতার অভিযোগ রয়েছে।
গবেষণার তথ্যমতে, ক্যাম্প ব্যবস্থাপনায় জনবলের ঘাটতি রয়েছে। মাত্র ১২ জন সিআইসি ও ২২ জন অ্যাসিস্টেন্ট সিআইসিসহ মোট ৩৪ জন কর্মকর্তা দিয়ে প্রায় দশ লক্ষ জনগোষ্ঠীর বসবাসরত ৩৪টি ক্যাম্প পরিচালিত হচ্ছে। জনবল ঘাটতির কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে একজন সিআইসিকে ৩-৫টি ক্যাম্পের দায়িত্ব পালন করতে হয়। এর ফলে ক্যাম্পের তদারকি ব্যাহত হয় এবং ক্যাম্প পরিচালনা ও ত্রাণ বণ্টনে ‘মাঝি’দের ওপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধির ফলে অনিয়ম ও দুর্নীতির ঝুঁকি সৃষ্টি হয়।
গবেষণায় দেখা যায়, রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তায় ২০১৭ সাল হতে ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত একবারও প্রয়োজনের বিপরীতে সম্পূর্ণ অর্থ পাওয়া যায়নি। ২০১৭, ২০১৮ এবং ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত প্রয়োজনের বিপরীতে প্রাপ্ত অর্থ যথাক্রমে ৭৩, ৬৯ ও ৫৫ শতাংশ। ফলে খাতভিত্তিক মৌলিক চাহিদা পূরণে (বিশেষত খাদ্য ও পুষ্টি, স্বাস্থ্য, আশ্রয়, পানি ও স্যানিটেশন, আশ্রয় ও সাইট ব্যবস্থাপনা) সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হয়। এরমধ্যেই আবার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ধীরে ধীরে রোহিঙ্গা সংকটের গুরুত্ব কমে আসছে, ফলে অর্থ সহায়তা কমে যাওয়ার পাশাপাশি ক্যাম্পগুলোতে মানবিক ত্রাণ কর্মসূচি সংকুচিত হয়ে আসার প্রবল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে, রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তায় জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ও আন্তর্জাতিক এনজিওর একাংশের পরিচালন ব্যয় তাদের কর্মসূচির ব্যয়ের তুলনায় বেশি হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। জাতিসংঘের সাতটি সংস্থার প্রদত্ত তথ্য (২০১৭-১৯) অনুযায়ী, সর্বোচ্চ পরিচালন ব্যয় ইউএন ওম্যান (৩২.৬%) ও সর্বনি¤œ জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (৩.০%। এখানে উল্লেখযোগ্য, জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থাগুলোর প্রদত্ত কর্মসূচি ব্যয়ের মধ্যে তাদের অনুদানে পরিচালিত এনজিওসমূহের পরিচালন ব্যয়ও অন্তর্ভুক্ত। তাই প্রকৃতপক্ষে রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তায় জাতিসংঘের অনুদানে পরিচালিত কর্মসূচির পরিচালন ব্যয়ের হারের সঠিক হিসাব শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট সংস্থা কর্তৃক করা সম্ভব।
গবেষণায় দেখা যায়, রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি বিদ্যমান। ৩৪টি ক্যাম্পের মধ্যে দুইটি নিবন্ধিত ক্যাম্প ব্যতীত বাকিগুলোতে সিআইসির অধীনে নিরাপত্তা কর্মী নেই। নিরাপত্তার ঘাটতির কারণে সিআইসিরা রাতের বেলা এসব ক্যাম্পে অবস্থান করেন না। বিভিন্ন ক্যাম্পে কমপক্ষে সাতটি সন্ত্রাসী গ্রæপের কার্যক্রম পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে। দালাল চক্রের সহায়তায় প্রাথমিকভাবে দালালদের ১০-২০ হাজার টাকা এবং নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর পর দেড় থেকে দুই লক্ষ টাকার বিনিময়ে ক্যাম্পভিত্তিক রোহিঙ্গাদের পাচারের অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে ক্যাম্পে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের মধ্যে আর্থিকভাবে স্বচ্ছলদের একাংশকে স্থানীয় রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে স্থানীয় জনগণের সাথে মূল ¯্রােতে মেশার সুযোগ করে দেওয়া এবং তাদের স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের স্বার্থ হাসিলে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে।
গবেষণায় সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন অংশীজনকর্তৃক নানা ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য উঠে এসেছে। এনজিও অ্যাফেয়ার্স ব্যুরোর কর্মকর্তাদের একাংশ কর্তৃক প্রকল্প অনুমোদনে (এফডি-৭) দীর্ঘসূত্রতা এবং অনুমোদন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে নিয়মবহির্ভ‚ত অর্থ ও উপঢৌকন দাবির অভিযোগ রয়েছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের একাংশের কাছ থেকে প্রকল্প কার্যক্রম শুরুর অনুমোদন পেতে কমপক্ষে ৭-১৫ দিন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক মাসেরও অধিক সময়ক্ষেপণের অভিযোগ পাওয়া যায়। উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের একাংশের কাছ থেকে প্রকল্প সমাপ্তির ছাড়পত্র সংগ্রহে যথাক্রমে প্রকল্প প্রতি নিয়ম-বহিভর্‚তভাবে ২০-৫০ হাজার টাকা ও ৫০-৭০ হাজার টাকা আদায় করা হয়। ত্রাণের মান ও পরিমাণ যাচাইয়ে ভিন্ন ভিন্ন যাচাই ব্যবস্থার কারণে সমন্বয়ের ঘাটতি এবং অনিয়ম ও দুর্নীতিসহ সময়ক্ষেপণের অভিযোগ রয়েছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কমিটির কর্মকর্তাদের একাংশ কর্তৃক নিয়মিত ও বিশেষ ত্রাণের মান ও পরিমাণ যাচাইয়ে ত্রাণের মালবাহী গাড়িপ্রতি নিয়ম-বহিভর্‚তভাবে ২,৫০০-৩,০০০ টাকা আদায় করে এবং না দিলে ৫-১৫ দিন সময়ক্ষেপণ করে বলে অভিযোগ রয়েছে। সিআইসিদের একাংশ এনজিওদের কার্যক্রম তদারকিতে বিশেষত কমিউনিটি মোবিলাইজেশন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণে প্রতি কর্মসূচি বাবদ নিয়ম-বহির্ভ‚তভাবে ২,০০০-৫,০০০ টাকা আদায় করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
গবেষণা অনুযায়ী, ক্যাম্প পর্যায়ে এফডি-৭ এবং জাতিসংঘের অনুদানে কার্যক্রম পরিচালনায় স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর একাংশের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে নি¤œমানের পণ্য ব্যবহার, কর্মসূচি অনুযায়ী কাজ না করা এবং কর্মসূচি বাস্তবায়নে ক্রয় প্রক্রিয়ায় ঠিকাদারদের সাথে যোগসাজশের মাধ্যমে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ ত্রাণের টোকেন প্রাপ্তিতে ‘মাঝি’দের বিরুদ্ধে নিয়ম-বহিভর্‚তভাবে ৫০০-১০০০ টাকা আদায় ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ পাওয়া যায়। এছাড়া ‘মাঝি’দের দ্বারা অভিযোগ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে নিয়ম-বহিভর্‚ত অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রদান জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বাগত জানানো হলেও এর ফলে বাংলাদেশ বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। বাংলাদেশ সরাসরিভাবে আর্থিক বোঝার পাশাপাশি বহুমুখী আর্থসামাজিক, পরিবেশগত ও নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়েছে। সরকারের বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশিত তথ্যমতে সংকট মোকাবেলায় ইতিমধ্যে সরকারের কমপক্ষে ২৩০৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। আন্তর্জাতিক সহায়তার ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা ধরে রাখার সম্ভাবনা কম দেখা যাচ্ছে এবং প্রয়োজনের তুলনায় আন্তর্জাতিক সূত্র থেকে অর্থের বরাদ্দ কমে আসছে। অন্যদিকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে দীর্ঘকাল অবস্থান করার সম্ভাবনা প্রকটতর হচ্ছে। তাই সরকারের উচিৎ হবে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সম্পৃক্ত করে এই সমস্যার বহুমুখী সম্ভাব্য প্রভাব বিশ্লেষণ করে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি প্রয়োজন প্রাক্কলন করা এবং তার ওপর ভিত্তি করে পর্যাপ্ত সম্পদ ও সক্ষমতা অর্জনের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানো।”
মানবিক সহায়তা কার্যক্রম বিশ^ব্যাপী সুশাসনের চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে উল্লেখ করে ড. ইফতেখারুজ্জামান আরো বলেন, “মানবিক সহায়তা কার্যক্রম একধরণের বিকাশমান শিল্পের মত। এজন্যই বিশ^ব্যাপী জাতিগত নিধন ও গণহত্যার মত নৃশংসতার প্রস্তুতি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের চোখের সামনে ঘটার পরও সেগুলো প্রতিরোধ করা হয় না। বরং ঘটনা ঘটার পর প্রতিকার করার জন্য সবাই মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে যৌক্তিকভাবেই সক্রিয় হয়ে উঠে। রোহিঙ্গা সংকটও এর ব্যতিক্রম নয়। রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংস অভিযানের প্রস্তুতির তথ্য জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহলের অজানা ছিল, এমনটি ধারণা করা অযৌক্তিক। তাই আন্তর্জাতিক আদালতে সত্যিকার অর্থেই ন্যয়বিচার চাইলে যারা এই জাতিগত নিধনের জন্য দায়ী তাদেরকে যেমন বিচারের আওতায় আনা উচিত তেমনি যারা এই নিধন ঘটতে যাচ্ছে জেনেও পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেয়নি কিংবা প্রতিরোধমূলক কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি বলে অভিযোগ আছে তাদেরকেও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সামর্থ্য অনুযায়ী কূটনৈতিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “মিয়ানমারের একগুঁয়েমি এবং ভারত, চীন, জাপানের মত শক্তিশালী দেশসমূহের কৌশলগত সমর্থনের ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে প্রতিবন্ধকতা অব্যাহত রাখতে মিয়ানমার অনড়। তাই এটি সরকারের কুটনৈতিক ব্যর্থতা নয়, কুটনৈতিক সীমাবদ্ধতা। ”
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের বিবেচনার জন্য ১৩ দফা সুপারিশ পেশ করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তায় এফডি-৭ এর আওতায় প্রকল্পগুলোকে বিশেষ ও জরুরি হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে কাজ শুরুর অনুমতি ও ছাড়পত্র প্রচলিত ব্যবস্থার পরিবর্তে আরআরআরসির মাধ্যমে করতে হবে; ক্যাম্প ব্যবস্থাপনায় আরআরআরসির জনবল বৃদ্ধি করতে হবে এবং প্রতিটি সিআইসির আওতায় নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করতে হবে; প্রতিটি ক্যাম্পে রাতের বেলা ক্যাম্প ইনচার্জদের (সিআইসি) অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে; সিআইসিদের মানবিক নীতিসমূহ মেনে চলার বাধ্যবাধকতাসহ এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে; মানবিক সহায়তায় খাতভিত্তিক প্রয়োজন অনুযায়ী অর্থ প্রাপ্তি নিশ্চিতে জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠনসহ, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে; রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ সরকারের আর্থিক ব্যয়সহ বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব নিরূপণ করে তা মোকাবেলায় কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এবং তার অর্থায়নসহ বাস্তবায়ন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরতে হবে; মানবিক সহাতায় প্রকল্প, অর্র্থ ব্যয়ের বিভিন্ন খাত, বাস্তবায়নের স্থান ও অগ্রগতি বিষয়ক তথ্য একটি সমন্বিত ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে এবং তা হালনাগাদ করতে হবে; কর্মসূচি বাস্তবায়নে বিভিন্ন স্তরে অনিয়ম ও দুর্নীতির যোগসাজশ নিয়ন্ত্রণে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে; মানবিক সহায়তায় কার্যক্রম ও কর্মসূচি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত অভিযোগ নিরসনে আরআরআরসি কার্যালয়ে কাঠামোবদ্ধ ‘অভিযোগ গ্রহণ ও নিরসন ব্যবস্থা’ চালু করতে হবে; রোহিঙ্গাদের সম্ভাব্য দ্রæততম সময়ে প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে বিভিন্ন রাষ্ট্র, জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দাতা সংস্থাদের সমন্বিত উদ্যোগ নিশ্চিত করার জন্য ক‚টনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে হবে।
গণমাধ্যম যোগাযোগ,
শেখ মন্জুর-ই-আলম
পরিচালক (আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন)
মোবাইল: ০১৭০৮৪৯৫৩৯৫
ই-মেইল: manjur@ti-bangladesh.org