ঢাকা, ৮ নভেস্বর ২০১৯: ন্যায়ভিত্তিক, সুশাসিত ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে একক ও সমষ্টিগতভাবে দুর্নীতিকে কার্যকরভাবে প্রতিরোধের সম্মিলিত প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর সদস্যদের বার্ষিক সভা ২০১৮-১৯। সভায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলমান ‘শুদ্ধি অভিযানে’ প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক “কাউকে ছাড় না দেওয়া হবে না” এই ঘোষনার কার্যকর নিশ্চয়তার আহ্বান জানানো হয়। এছাড়া, অনিয়ম, দুর্নীতি ও সহিংসতামুক্ত শিক্ষাঙ্গণ, সকল নাগরিকের জন্য মানবাধিকার নিশ্চিত, সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ এর কঠোর বাস্তবায়ন এবং আর্থিক খাতে আস্থা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে স্বাধীন কমিশন গঠনের মাধ্যমে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানান টিআইবির সদস্যবৃন্দ। একইসাথে সভার ঘোষণাপত্রে দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে কার্যকর দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় উন্নয়নে স্বচ্ছতা ও সকলের অংশগ্রহণ, অবাধ তথ্য প্রবাহ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল পর্যায়ের অংশগ্রহণকারীদের নিরাপত্তাসহ উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিতের তাগিদ জানানো হয়।
বৃহস্পতিবার বিকেলে টিআইবির ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় সদস্যরা জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে জনগণকে অধিকতর সম্পৃক্ত করে দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলন জোরদারের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এর সঞ্চালনায় সভায় সভাপতিত্ব করেন টিআইবির সাধারণ পর্ষদে সদস্যদের নির্বাচিত প্রতিনিধি কাজী মোঃ মোরতুজা আলী। টিআইবির সাথে স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ৫১ জন সদস্য সভায় অংশগ্রহণ করেন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে টিআইবি পরিচালিত বহুমুখী গবষেণা, অধিপরার্মশ ও প্রচারণাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট আর্থিক হিসাবের সর্বোচ্চ মানসম্পন্ন নিরীক্ষা প্রতিবেদনের ওপর সদস্যগণ সন্তোষ প্রকাশ করেন। একইসাথে টিআইবির কার্যক্রম ভবিষ্যতে আরো গতিশীল ও কার্যকর হবে, এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে একের পর এক রক্তক্ষয়ী ছাত্র সহিংসতা, ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম, দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবদুষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পৃষ্ঠপোষকতা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যত নিস্ক্রিয়তা তথা শিক্ষাঙ্গণে শৃঙ্খলা বজায়ে সরকারের ব্যর্থতায় সদস্যবৃন্দ ক্ষোভ প্রকাশ করেন। একইসাথে, সরকারের চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে ক্ষমতাসীন ছাত্র ও যুবনেতৃবৃন্দের একাংশের সাথে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসমূহের নানা শ্রেণি-পেশার কমকর্তা-কর্মচারীর অবাধ দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্রকে মূলত রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ও রাজনৈতিক পরিচয়ে দুর্নীতির গভীরতর ও ব্যাপকতর বিস্তৃতির পরিচায়ক হিসেবে অবিহিত করেন সদস্যবৃন্দ। পাশাপাশি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিরাপরাধ সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর বুলিইংসহ বিভিন্ন প্রকার নির্যাতন এবং সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফেরত আসা নির্যাতনের শিকার নারী শ্রমিকদের আশঙ্কাজনক চিত্রের প্রেক্ষিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনতিবিলম্বে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদ জানানো হয়।
সমাজের সকল পর্যায়ে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ প্রতিরোধে ‘কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না’ মর্মে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যর সাথে সদস্যবৃন্দ একাত্মতা ঘোষণা করে অনিয়মে জড়িত সকলকে পরিচয় ও অবস্থান নির্বিশেষে জবাবদিহিতার আওতায় আনা অপরিহার্য এই অভিমত ব্যক্ত করেন। পাশাপাশি, শিক্ষাঙ্গণের সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এর পাশাপাশি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে বিরত থাকা এবং উত্থাপিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় ন্যায় বিচার নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানান। একইসাথে, দুর্নীতি প্রতিরোধে তরুণদের মানবিক মূল্যবোধ বিকাশে নৈতিক শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেন সদস্যবৃন্দ।
সভায় সদস্যবৃন্দ ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ ও ব্যাপক অনিয়মে জর্জরিত ব্যাংকিং খাতের সংস্কারের লক্ষ্যে ব্যাংকিং কমিশন করার সিদ্ধান্ত ইতিবাচক বিবেচনা করে স্বাগত জানান কিন্তু বহুল প্রত্যাশিত কমিশনটি বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে গঠন করা হলে তা একটি অর্থহীন ও অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত হবে অভিমত প্রকাশ করেন সদস্যবৃন্দ। স্বার্থের দ্বন্দ্বের কারণে এধরনের কমিশন কর্তৃক নিরপেক্ষ ও নির্মোহভাবে ব্যাংকিং পরিস্থিতি পর্যালোচনা এবং কার্যকর সুপারিশ প্রণয়ন সম্ভব হবে না বলে মন্তব্য করে, সম্পূর্ণ স্বাধীন একটি কমিশন গঠনের আহবান জানিয়েছেন টিআইবি সদস্যবৃন্দ। সভার শেষে এক ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হয়। ঘোষণাপত্রে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলনকে আরো বেগবান ও কার্যকর করতে বিবেককে চির জাগ্রত রেখে অন্য সকলের, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে দুর্নীতি প্রতিরোধে উদ্বুদ্ধ করার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা হয়। এছাড়া, ঘোষণাপত্রে দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে দুর্নীতি দমন কমিশন-কে অধিকতর কার্যকর করার দাবি জানানো হয়। একইসাথে তথ্যের অধিকার, অবাধ তথ্য প্রবাহ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত; তৃণমূলে কার্যকর, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক সেবা, এবং সকল স্তরে কার্যকর, জবাবদিহিমূলক ও স্বচ্ছ প্রতিষ্ঠানের বিকাশ এর দাবিসহ ৯ দফা দাবি উত্থাপন করা হয় সভার ঘোষণাপত্রে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলনের কার্যক্রমে জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধিতে আগ্রহী বিভিন্ন পেশাজীবী ও সাধারণ নাগরিককে টিআইবি সদস্যভুক্ত করে আসছে। পাশাপশি সারাদেশে সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) ও ইযুথ এনগেজমেন্ট অ্যান্ড সাপোর্ট (ইয়েস) প্ল্যাটফর্মে স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে যুক্ত রয়েছেন প্রায় সাত হাজার নাগরিক যার সিংহভাগ তরুণ প্রজন্মের সদস্য।