সংবাদ বিজ্ঞপ্তি
খেলাপী ঋণ আদায়ে নেতৃত্বের সংকট, রাজনৈতিক প্রভাব এবং ঋণ খেলাপি পারিবারিক ও ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটের দৌরাত্মে
ব্যাংকিং খাত খাদের কিনারায়; সুস্থ ও নিরাপদ ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় ১০ দফা সুপারিশ টিআইবির
ঢাকা, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০: দেশে ২০০৯ সালের শুরু থেকে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়কালে বছরে গড়ে নয় হাজার ৩৮০ কোটি টাকা ঋণ খেলাপি হয়েছে। অর্থাৎ এই সময়কালে খেলাপী ঋণ বৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় ৪১৭ শতাংশ। ঋণ খেলাপিদের অনুকূলে বারবার আইন সংশোধন ও নীতি প্রণয়ন ব্যাংকিং খাতকে ঋণ খেলাপি বান্ধব করেছে এবং খেলাপি ঋণকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছে যা নিয়মিত ঋণ গ্রহীতাকেও খেলাপি হতে উৎসাহিত করছে। ব্যাংকিং খাত তদারকি ও খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ: বাংলাদেশ ব্যাংকের সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায় শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষ্যে আজ এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটির মতে, সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণ আদায়ে যথাযথ ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় বিপুল পরিমাণের খেলাপি ঋণ ব্যাংকিং খাতে বিশেষত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে চরম মূলধন সংকট তৈরি করেছে। আর এই সংকট কাটাতে প্রতিবছর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে জনগণের করের টাকা থেকে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ কিছু মানুষের অনিয়ম-দুর্নীতির বোঝা ক্রমাগতভাবে জনগণের উপর চাপানো হচ্ছে। সংবাদ সম্মেলনে ঋণ খেলাপি হওয়া এবং তা আদায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের দূর্বল তদারকি ব্যবস্থার সমালোচনা করে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে সুস্থ ও নিরাপদ ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় ১০ দফা সুপারিশ প্রদান করে টিআইবি।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এবং উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের। গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। গবেষণা দলের অপর সদস্যরা হলেন এই বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. জুলকারনাইন ও অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার অমিত সরকার। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলম।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সার্বিকভাবে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি কর্মকা-ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুশাসনের চ্যালেঞ্জসমূহ পর্যালোচনা করে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে সুপারিশ প্রণয়ন করা এই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য। গবেষণার জন্য ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময় বিবেচনা করে ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ নিয়ন্ত্রণ বিশেষত ঋণ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি ভূমিকা সুশাসনের বিভিন্ন সূচকের আলোকে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিপুল পরিমাণের খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি কার্যক্রমের ক্ষেত্রে প্রধানত দুই ধরনের সুশাসনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। একটি হলো বাহ্যিক প্রভাব- যার মধ্যে রয়েছে আইনি সীমাবদ্ধতা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও ব্যবসায়িক প্রভাব এবং অপরটি হচ্ছে অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ- যার মধ্যে রয়েছে তদারকি সক্ষমতায় ঘাটতি, নেতৃত্বের সক্ষমতায় ঘাটতি, বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতায় ঘাটতি এবং তদারকি কাজে সংঘটিত অনিয়ম দুর্নীতি।
গবেষণায় দেখা যায়, সরকারি নীতি ও কৌশলসমূহে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংকিং খাত সংস্কার ও নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের অধিকতর সুশাসনের কথা বলা হলেও এগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি রয়েছে। একদিকে ব্যবসায়ীদের ইচ্ছায় সরকার কর্তৃক তাদের অনুকূলে আইন পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতে ব্যবসায়ীদের অবাধ প্রবেশ ও নিয়ন্ত্রণের সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে নানা আইনী বাধা, সদিচ্ছার ঘাটতি ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক তার প্রাপ্ত ক্ষমতা চর্চায় ব্যর্থ হচ্ছে। এছাড়া তদারকির সক্ষমতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি ও তদারকি কার্যক্রমে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রমশ অবনমন ঘটেছে এবং প্রতিষ্ঠানটি স্বার্থসংশ্লিষ্টদের আজ্ঞাবাহীতে পরিণত হচ্ছে। পাশাপাশি সরকারের সদিচ্ছার ঘাটতি এবং রাজনৈতিক প্রভাব ও হস্তক্ষেপের কারণে ব্যাংকিং খাতে আইনের লঙ্ঘন ও অনিয়ম-দুর্নীতির মাত্রা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যার মাধ্যমে সমগ্র ব্যাংকিং খাতে কয়েকটি ব্যবসায়ী গ্রুপের পরিবারতন্ত্র বা গোষ্ঠীতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এবং সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এসব গোষ্ঠী বা পরিবার রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে আমানতকারীদের হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ হিসেবে নিজেদের ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের দখলে নিয়ে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণ অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ ও বিদেশে অর্থ পাচার জাতীয় অর্থনীতির বিকাশে ব্যাংকিং খাতের কাক্সিক্ষত ভূমিকাকে ব্যাহত করছে।
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন সময়ে খেলাপি ঋণ হ্রাস এবং ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হলেও তা কার্যকর না করে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক বার বার ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ ও পুনর্গঠনের সুযোগ প্রদান করা হয়। সর্বশেষ ২০১৯ সালের মে মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি নির্দেশনায় খেলাপি ঋণের মাত্র দুই শতাংশ ফেরত দিয়ে পুনঃতফসিলীকরণের মাধ্যমে ১০ বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধের সুযোগ প্রদান করা হয়। এভাবে পুনঃতফসিলের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ আদায় না করেই সেপ্টেম্বর ২০১৯ হতে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ কমিয়ে মার্চ ২০২০ পর্যন্ত ৯২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ হিসেবে দেখানো হয়। ঋণ খেলাপিদের বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধা প্রদান ও খেলাপি ঋণ কম দেখাতে বিবিধ কৌশল অবলম্বন সত্ত্বেও জুন ২০২০-এ খেলাপি ঋণের পরিমাণ পুনরায় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৯৬ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। অথচ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসমূহের খেলাপি ঋণের কারণে সৃষ্ট মূলধন ঘাটতি মেটাতে ২০১২-১৩ অর্থ বছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থ বছর পর্যন্ত সরকার কর্তৃক ১২ হাজার ৪৭২ কোটি ৮৭ লক্ষ টাকা ভর্তুকি প্রদান করা হয়।
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, বিশেষজ্ঞদের মতে প্রয়োজনীয়তা না থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০০৯ সালের পর থেকে রাজনতৈকি প্রভাবরে কারণে বাংলাদশে ব্যাংক ১৪টি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন প্রদান কর।ে বিভিন্ন ব্যাংকের তদারকি কার্যক্রমেও রাজনৈতিক প্রভাব ও হস্তক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়। অনেক সময়ই বাংলাদেশ ব্যাংক যে কোনো ব্যাংকের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে গেলে শীর্ষ পর্যায়ের বিভিন্ন মন্ত্রী/মন্ত্রণালয় থেকে টেলিফোনে চাপ প্রয়োগ করে ব্যবস্থা গ্রহণে বাধা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ব্যাংক উদ্যোক্তাদের অধিকাংশ সরাসরি ক্ষমতাসীন দলের অংশ বা সরকারের ঘনিষ্ঠ হওয়ার ফলে আইন লঙ্ঘন করলেও অনেক ক্ষেত্রে তাদের ছাড় দেওয়া হয়ে থাকে।
গবেষণায় বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীন নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি কার্যক্রমে বাহ্যিক প্রভাব বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আইন ও নীতি কাঠামোর সীমাবদ্ধতা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে ব্যাংকিং খাত নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির জন্য বিদ্যমান আইনী কাঠামোতে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতাকে খর্ব করে, নিয়ন্ত্রণ ও তাদরকি কার্যক্রমকে দুর্বল বা সীমিত করে এবং রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি করে। পাশাপাশি ‘ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি’র সংজ্ঞা এবং উপযুক্তমাত্রায় শাস্তি নির্ধারণ না করায় সরকার কর্তৃক খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারে ঋণ খেলাপিদের জন্য প্রদত্ত সুবিধাদি ও প্রণোদনাসমূহ সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য প্রযোজ্য হওয়ায় ঢালাওভাবে ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপিরাও ভোগ করে থাকে। একক ব্যক্তি বা গ্রুপ একটি ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ কী পরিমান ঋণ গ্রহণ করতে পারবে তা একক বৃহত্তম ঋণসীমা নীতিমালায় নির্ধারিত হলেও সার্বিকভাবে ব্যাংকিং খাতে ব্যক্তি ও গ্রুপের সর্বোচ্চ ঋণসীমা নির্ধারণ উল্লেখ না থাকার সুযোগে ঋণ গ্রহীতারা বিশেষত ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিরা বিভিন্ন কৌশল ও যোগসাজশের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক হতে ঋণ বের করে নিচ্ছে; যার উল্লেখযোগ্য অংশ পরবর্তিতে খেলাপি হয়ে পড়ছে। আবার আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের কারণে সৃষ্ট তারল্য সংকট কাটাতে বিভিন্ন অজুহাতে এডিআর এর হার বৃদ্ধি, নগদ জমা সংরক্ষণ (সিআরআর) ও রেপো রেট হ্রাসের ঘটনা লক্ষ্য করা যায় এবং সম্প্রতি সময়ে করোনা পরিস্থিতিতে ‘ইন্টার্নাল ক্রেডিট রিস্ক রেটিং’কে শিথিল করে ঋণ খেলাপিদের প্রণোদনা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়।
গবেষণায় দেখা যায়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর, খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গভর্নর নিয়োগ বিষয়ক অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে গভর্নর নিয়োগ দেয়া হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকে সরকারের পছন্দ মাফিক গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ দেয়া হয়। এমনকি বিভিন্ন সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও একই ব্যক্তিকে গভর্নর হিসেবে পুনঃনিয়োগ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক অধ্যাদেশ সংশোধন করে গভর্নরের বয়সসীমা বৃদ্ধি করা হয়। আইনীভাবেও ব্যবসায়ী ও ব্যাংক স্বার্থসংশ্লিষ্ট ক্ষমতাধর ব্যক্তিবর্গের প্রভাবে ব্যবসায়ীদের অনুকূলে আইন পরিবর্তন এবং নানাভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীন নীতি ও বিধি-বিধান প্রণয়নে হস্তক্ষেপ করা হয়। যেমন, ব্যাংক কোম্পানী আইন, ১৯৯১ এর ধারা সংশোধনের মাধ্যমে একই পরিবার থেকে ২ জনের পরিবর্তে ৪ জন পর্যন্ত পরিচালক রাখার বিধান করা হয় এবং পরিচালকের মেয়াদ পরপর দুইবারে সর্বোচ্চ ছয় বছরের পরিবর্তে পরপর তিনবারে সর্বোচ্চ নয় বছর থাকার বিধান কিছু পরিবারের হাতে ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাবে চেয়ারম্যান বা পরিচালনা পর্ষদ নিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করা হয় এবং অনুগত প্রধান নির্বাহী নিয়োগ দেয়া হয়। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী নিয়োগেও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শ উপেক্ষা করা হয়। এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলোর দৃষ্টান্ত উপেক্ষা করে বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্ষদে তিনজন সরকারি কর্মকর্তা এবং দুইজন সাবেক আমলা রাখা হয়েছে- যা পরিচালনা পর্ষদের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরোপের ঝুঁকি সৃষ্টি করে।
গবেষণায় বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি কার্যক্রমে অভ্যন্তরীণ সুশাসনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে নেতৃত্বের সক্ষমতায় ঘাটতি ও চ্যালেঞ্জ অন্যতম হিসেবে উঠে এসেছে। বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতসংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারকারী গ্রুপের চাপের কাছে গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদের নমনীয়তা লক্ষনীয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর সরকারের হস্তক্ষেপ করার চেষ্টার বিপরীতে সরকারের চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে গভর্নরের পদত্যাগের দৃষ্টান্ত থাকলেও বাংলাদেশে তা অকল্পনীয়। পাশাপাশি জনবল সংকটের কারণে তদারকি কার্যক্রমকে সীমাবদ্ধ করে এবং অনিয়ম-দুর্নীতি চিহ্নিত করতে বিলম্ব হয়। সার্বিকভাবে সংশ্লষ্টি ব্যাংকিং পরিদর্শন দলের ৪৫.৭ শতাংশ প্রথম শ্রেণির পদ শূন্য রয়েছে এবং অফ সাইট সুপারভিশনে ৩৬.৮ শতাংশ পদ শূন্য রয়েছে। এতে পরিদর্শন সময়কাল ও পরিদর্শন দলে জনবল ঘাটতির কারণে নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায়ও ঘাটতি দেখা যায়। আবার পরিদর্শন দলের ক্ষমতা হ্রাস করায় পরিদর্শন কার্যক্রমকে মন্থর করে এবং ব্যাংকিং খাতের অনেক অনিয়ম-দুর্নীতি ও জালিয়াতির ঘটনা উদঘাটনে বিলম্ব হয়। জনবল ঘাটতির কারণে পর্যালোচনা প্রতিবেদন প্রেরণেও বিলম্ব হয়।
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে তদারকি কার্যক্রমে অনিয়ম-দুর্নীতি প্রতিরোধে সুশাসনের ঘাটতি দেখা যায়। যেমন, অনেক তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়িত না হওয়ায় তদন্ত কার্যক্রম মূল্যহীন হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের দুই-একজন কর্মকর্তার সাথে কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠীর যোগসাজশের মাধ্যমে পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লিখিত অনিয়ম চূড়ান্ত প্রতিবেদন থেকে বাদ দেওয়া হয়ে থাকে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়া বিভিন্ন ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনগুলো গোপন করা হয় এবং পরবর্তীতে আর ব্যবহার না করা হয় না। তদারকি কাজে নিযুক্ত কর্মকর্তাগণের একাংশ আর্থিক বা অন্যান্য সুবিধার বিনিময়ে প্রকৃত তথ্য গোপন করে দুর্বল তদন্ত প্রতিবেদন প্রণয়ন করে থাকে। বেসরকারি ব্যাংকসমূহ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একাংশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে স্বজনপ্রীতির প্রভাবে অনেক ক্ষেত্রে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে বিরত থাকার অভিযোগ পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনেকে অবসরের পরপরই যে প্রতিষ্ঠানগুলোর তদারকি করতেন সেখানে উচ্চ পদে যোগদান করে থাকেন। এতে স্বার্থের দ্বন্দ প্রকট আকার ধারণ করে।
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। যেমন, পরিচালনা পর্ষদের সীমিত ভূমিকা থাকায় ব্যাংকিং সংশ্লিষ্ট কোন নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে পর্ষদের অনুমোদন নেওয়ার বিষয়টি আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক অধ্যাদেশ, ১৯৭২ অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রম সম্পর্কে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে প্রতিবেদন প্রেরণের বাধ্যবাধকতা থাকলেও, মন্ত্রী-সংসদ সদস্যসহ বিপুল সংখ্যক রাজনৈতিক ব্যক্তি ব্যাংকিং খাতের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার ফলে এই জবাবদিহি কাঠামো ততটা কার্যকর হয়ে উঠতে পারেনি। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য প্রকাশে ঘাটতি থাকায় সকল ধরনের তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে তা ‘আর্থিক খাতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে’- নির্বিচারে এই অজুহাত দেখানো হয়। ফলে খেলাপি ঋণ ও ব্যাংকের অবস্থা সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। যেমন, সম্প্রতি জাতীয় সংসদে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রেরিত তিনশত ঋণ খেলাপির তালিকা প্রকাশ করা হলেও সেখানে শুধু প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ করা হয়েছে। অথচ এই তালিকার প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অনেক ব্যক্তিই একাধিক প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়েছে এবং খেলাপি হয়েছে। কিন্তু যে সকল ব্যক্তি একাধিক প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ গ্রহণ করেছে তাদের নাম প্রকাশ করা হয়নি। আবার যারা একাধিকবার রাজনৈতিক বিচেনায় ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ করে পুণরায় ঋণ খেলাপি হয়েছে তাদের নামও কখনও প্রকাশ করা হয় না।
সংবাদ সম্মেলনে ব্যাংকিং খাত খাদের কিনারায় উল্লেখ করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “রাষ্ট্র মালিকানাধীন বা ব্যক্তি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যে জনগণের অর্থ ও আমানত নিয়েই ব্যবসা করে থাকে- এই বাস্তবতার স্বীকৃতি বাংলাদেশে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। খেলাপী ঋণগ্রহীতাদের স্বেচ্ছাচারী প্রবণতায় মনে হয়, ব্যাংকে গচ্ছিত জনগণের অর্থ যেন কিছু মানুষের ব্যক্তিগত সম্পদ; যা তাদের খুশিমত ব্যবহার করা যাবে। আবার ব্যাংক মালিক, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সরকার- এই তিন পক্ষও ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ যে জনগণের সম্পদ সেটি ভুলে গিয়ে লুটপাটকারী তথা ঋণখেলাপীদেরকেই ক্রমাগতভাবে সুযোগ করে দিচ্ছে। অনেক সময় তারা ঋণখেলাপী, জালিয়াতিকারী, অর্থ আত্মসাৎকারী ও অর্থ পাচারকারীদের সহায়ক শক্তি হিসেবেও ভূমিকা পালন করছে। এমনকি সরকারকেও তাদের কাছে জিম্মি মনে হয়। নির্বাহী পরিচালক বলেন, “যেই বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব জনগণের আমানত তদারকি এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করা- তারাও নেতৃত্বের অদক্ষতা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং ঋণ খেলাপীদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে খেলাপী ঋণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অকার্যকর একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।”
ব্যাংকিং খাতের প্রকট সংকটময় এই পরিস্থিতির মূলে বাংলাদেশের দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে দায়ী করে ড. জামান আরো বলেন, “এদেশের রাজনীতি ব্যবসার সাথে একাকার হয়েই ক্ষ্যান্ত হয় নি বরং তা ব্যবসায়ীদের হাতেই জিম্মি হয়ে পড়েছে। যার কুপ্রভাব ব্যাংকিং খাতেও পড়েছে। এর ফলে সরকারি ঘোষণায় খেলাপী ঋণ নিয়ন্ত্রণ ও বাণিজ্যিক ব্যাংকিং খাত নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের সুশাসন ইত্যাদি বিষয়ে জোরালো অঙ্গীকার থাকলেও তার কোন প্রয়োগ বা কার্যকর বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না; যা ব্যাংকিং খাতকে খাদের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়েছে। এতে পুরো অর্থনীতিই এক অভূতপূর্ব নাজুক অবস্থায় পড়েছে। যদি এখনই এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হয় তাহলে ধ্বস অপরিহার্য বললে অত্যুক্তি হবে না এবং আমানতের অর্থ জনগণের হওয়ায় এর সম্পূর্ণ বোঝাও নিঃসন্দেহে জনগণের ওপরই পড়বে। তাই এই সংকট থেকে উত্তরণে অবিলম্বে সম্পূর্ণ স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং সরকার কিংবা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণমুক্ত একটি কমিশন গঠন করে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী কর্মপরিকল্পনাসহ কৌশল প্রণয়ন ও অবিলম্বে বাস্তবায়ন অপরিহার্য।”
গবেষণায় প্রাপ্ত পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে সুস্থ ও নিরাপদ ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় ১০ দফা সুপারিশ করেছে টিআইবি। উল্লেখযোগ্য সুপারিশগুলো হলো- ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ ও ব্যাপক অনিয়মে জর্জরিত ব্যাংকিং খাত সংস্কারের জন্য এখাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন করতে হবে; ব্যাংক কোম্পানী আইনের ৪৬ ও ৪৭ ধারা সংশোধন করে বাংলাদেশ ব্যাংককে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির পূর্ণ ক্ষমতা দিতে হবে; নিয়োগ অনুসন্ধান কমিটির গঠন, দায়িত্ব-কর্তব্য ও নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনাসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সদস্য, গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ ও অপসারণ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট লিখিত নীতিমালা করতে হবে; বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে তিনজন সরকারি কর্মকর্তার স্থলে বেসরকারি প্রতিনিধির সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে; ব্যাংক সংশ্লিষ্ট আইনসমূহে আমানতকারীর স্বার্থ পরিপন্থী ও ব্যাংকিং খাতে পরিবারতন্ত্র কায়েমে সহায়ক সকল ধারা সংশোধন/বাতিল করতে হবে; রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ সকল বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগে অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে একটি প্যানেল গঠন করে সেখান থেকেই বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগের বিধান করতে হবে; রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তিদের ব্যাংক পরিচালক হওয়া থেকে বিরত রাখার বিধান করতে হবে এবং ব্যাংক পরিচালকদের ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংকের সরাসরি নজরদারির মাধ্যমে অনুমোদনের ব্যবস্থা রাখতে হবে; ব্যাংক পরিদর্শনের সংখ্যা ও সময়কাল বৃদ্ধি, প্রত্যক্ষভাবে পরিদর্শন কাজের সাথে সম্পৃক্ত বিভাগসমূহের শূন্য পদসমূহ অবিলম্বে পূরণ, পরিদর্শন প্রতিবেদন যুক্তিসংগত সময়ের মধ্যে সমাপ্ত ও এর সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে এবং পরিদর্শনে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা পরিদর্শন দলকে দিতে হবে; তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি ও বাস্তবায়নে সংঘটিত অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে; ইত্যাদি।
গণমাধ্যম যোগাযোগ:
শেখ মনজুর-ই-আলম
পরিচালক (আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন)
মোবাইল: ০১৭০৮৪৯৫৩৯৫
ই-মেইল:
This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.