সুশাসনের ঘাটতি ও দুর্নীতিতে জর্জরিত বাংলাদেশের পোশাক খাত:
আইনের কার্যকর প্রয়োগের আহ্বান টিআইবি’র
ঢাকা, ৩১ অক্টোবর ২০১৩: দায়িত্ব পালনে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সংবেদনশীলতার ঘাটতিসহ বহুবিধ সমস্যা থেকে উত্তরণে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) তৈরি পোশাক শিল্পে সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শ্রমিকদের কর্ম নিরাপত্তা, অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিতকল্পে ২৫ দফা সুপারিশ উত্থাপন করে তা বাস্তবায়নের দাবী জানিয়েছে। আজ প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ‘তৈরি পোশাক খাত: সুশাসনের সমস্যা ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনের সারাংশ উপস্থা্পন করে টিআইবি জানায়, আইনের শাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, অংশগ্রহণ এবং সহনশীলতার ঘাটতিজনিত সুশাসনের অভাবেই বাংলাদেশের পোশাক খাতে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। ফলে রানা প্লাজা, তাজরিন ফ্যাশনের মত ট্রাজিক দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা যাচ্ছে না। বিরাজমান বহুমুখী সংকট নিরসনে আইনের কার্যকর প্রয়োগের পাশাপাশি একটি পৃথক মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছে টিআইবি।
টিআইবি’র গবেষণায় তৈরি পোশাক খাতের সংশ্লিষ্ট আইন ও নীতি কাঠামো পর্যালোচনা, অনিয়ম ও দুর্নীতির চিহ্ন চিত্রিত করা, তৈরি পোশাক খাতের সাথে জড়িত সরকারের ১৭টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৬টি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকাসহ অংশীজন হিসেবে বিজিএমই্এ, শ্রমিক সংগঠন এবং বায়ারদের ভূমিকা পর্যালোচনা পূর্বক ২০১৩ সালের জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত তথ্য সংগৃহীত ও বিশ্লেষিত হয়। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন শরীফ আহমেদ চৌধুরী, ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার, রিসার্চ এ্যান্ড পলিসি এবং নাজমুল হুদা মিনা, এ্যাসিস্টেন্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার, রিসার্চ এ্যান্ড পলিসি। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি সুলতানা কামাল, নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এবং উপ-নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের।
সংবাদ সম্মেলনে সুলতানা কামাল সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগের দায় চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা পরিহার করে পারষ্পরিক সমন্বয় সাধনের আহ্বান জানান। জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ও বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী পোশাক শিল্পের খাতটিকে বাঁচিয়ে রাখতে সংশ্লিষ্ট সকলকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, তৈরী পোশাক শিল্পে সুশাসন নিশ্চিত করার দায়িত্ব উদ্যোক্তা ও সরকার উভয়েরই। তিনি আরো বলেন, শ্রমিক কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য তহবিল গঠনের বিকল্প নেই। সেই সাথে তিনি এ খাতে দুর্নীতি ও সংঘটিত দুর্ঘটনার সাথে জড়িত ও দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনার দাবী জানান।
তৈরী পোশাক খাতের সংশ্লিষ্ট আইন ও নীতি কাঠামো পর্যালোচনা করে প্রতিবেদনে বলা হয়, জুলাই ২০১৩ সালে বাংলাদেশ শ্রম আইন সংশোধিত হলেও তৈরী পোশাক খাতের জন্য এখনো কোন বিধিমালা প্রণীত হয়নি। শ্রমিকের সংজ্ঞায় তদারকি কর্মকর্তাদের যুক্ত করে একদিকে শ্রমিকের ব্যাপ্তি বৃদ্ধি করা হয়েছে অন্যদিকে কারখানা স্থাপনের কতদিনের মধ্যে ট্রেড ইউনিয়ন করতে হবে তা সুস্পষ্ট নয়। মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণের বিধানকে অপর্যাপ্ত ও অমানবিক আখ্যায়িত করে ধর্মঘটে অংশ হিসেবে মজুরি কর্তনের এবং অসদাচারণের কারণে ক্ষতিপূরণ ছাড়া শ্রমিক বরখাস্তের বিধানকে আইএলও কনভেনশনের পরিপন্থী বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
তৈরী পোশাক খাতে জড়িত অংশীজনদের সমস্যা, অনিয়ম ও দুর্নীতির ব্যাপকতার উল্লেখ করে প্রতিবেদনে জানানো হয় কারখানা স্থাপনে ১৭টি প্রতিষ্ঠান থেকে সনদ সংগ্রহ করতে যেয়ে মালিক পক্ষকে ৭ লক্ষ টাকা থেকে ২০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত সরকারি ফি’র অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয়। অন্যদিকে প্রতিবেদনে বলা হয়, বিজিএমইএ তার নির্ধারিত দায়িত্ব পালন না করে এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে নানা কাজে জড়িত হওয়ায় পোশাক খাতে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের সুযোগের সৃষ্টি হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী টেকনিক্যাল ও সোশ্যাল কমপ্লায়ান্সের অনিয়মের সাথে মালিকপক্ষ জড়িত। অন্যদিকে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, রাজউক, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, ফায়ার সার্ভিস ও ডিফেন্স ও শ্রম পরিদপ্তর তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়, অর্থের বিনিময়ে ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা মালিকের স্বার্থে কাজ করেন। এছাড়াও প্রতিবেদনে বায়ারদের অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, যোগসাজশের মাধ্যমে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে কারখানার প্রকৃত চিত্র গোপন করা হয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী তৈরী পোশাক কারখানায় কমপ্লায়েন্স ঘাটতি, অগ্নি দুর্ঘটনা, ভবন ধস, আইন ও মানবাধিকার লংঘন, মালিক-শ্রমিক আস্থার সংকট, আতাঁতের মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনিয়ম ও দুর্নীতির বিভিন্ন কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে সমূহের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, শ্রম আইনের সীমাবদ্ধতা, পর্যাপ্ত শাস্তি ব্যবস্থার অনুপস্থিতি, বিদ্যমান আইন ও বিধিমালার যথাযথ প্রয়োগ ও তদারকির সক্ষমতার ঘাটতি, বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা, মালিক ও ক্রেতাদের অতিরিক্ত ও দ্রুত মুনাফার প্রবণতা, অপর্যাপ্ত মজুরি কাঠামো, নিম্নতম মজুরী নির্ধারণ ও ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে মালিকদের নেতিবাচক প্রভাব এবং স্বার্থের দ্বন্দ্ব। প্রতিবেদনে জানানো হয় বর্তমান সংসদের অন্তত ১০% শতাংশ সদস্য তৈরী পোশাক শিল্পে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত বলে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থে সিদ্ধান্ত গ্রহনের ঝুঁকির সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে।
সুশাসনের ঘাটতির প্রভাবে তৈরী পোশাক শিল্পে শ্রমিকের মৃত্যু ও পঙ্গুত্ববরণ, জীবনযাত্রার মানের অবনমন, শিল্পে অস্থিরতা বৃদ্ধি, অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকরণ, ব্র্যান্ড সুনাম ক্ষণ্ন এবং রফতানি হ্রাস, জিএসপি সুবিধা বাতিল এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন কর্তৃক বাতিলের ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
সুশাসনের সমস্যা থেকে উত্তরনে প্রতিবেদনে যে সকল সুপারিশ করা হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: কর্মপরিবেশের উন্নয়নে একটি সমন্বিত আচরণ বিধিমালা প্রণয়ন এবং সকল কারখানায় জেন্ডার কোড অব কন্ডাক্ট চালু করা, দুর্ঘটনার জন্য মালিকের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলার সুবিধার্থে শ্রম আইনের সংশোধন, আহত ও নিহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ বৃদ্ধি, ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ এবং শ্রম আদালতে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি। এছাড়া পোশাক খাতে একটি কেন্দ্রিয় তহবিল গঠনে রফতানিকৃত পোশাকের সংখ্যা প্রতি ১ থেকে ১.৫ সেন্ট কল্যাণ তহবিলে প্রদান যেখানে ক্রেতা-মালিকের অনুপাত হবে ৭৫:২৫ এবং তহবিল বোর্ডে নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণের প্রস্তাব করা হয় প্রতিবেদনে। এছাড়া কারখানার সঠিক কর্মপরিবেশ, নিরাপত্তা ও শ্রম অধিকার নিশ্চিত কল্পে আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার আলোকে বায়ারদেরকে সুনির্দিষ্ট জবাবদিহিতায় আনার প্রস্তাব করা হয় প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে অন্যান্য সুপারিশের মধ্যে রয়েছে ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, তদারকি সংস্থার দক্ষতা, জনবল ও সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং দুর্ঘটনা পরবর্তী বিভিন্ন অনুদান ও ব্যয়ের তথ্য এবং এ সংক্রান্ত দেশী-বিদেশী বিভিন্ন কর্মসূচির বিশদ বিবরণ জনসমক্ষে প্রকাশ; জরুরি যোগাযোগ ঠিকানা ও মোবাইল নম্বরসহ অগ্নি নিরোধী পরিচয়পত্র প্রদান এবং হাজিরা খাতার নিরাপদ সংরক্ষণ এবং প্রতিটি তৈরি পোশাক কারখানার কমপ্লায়েন্স, অগ্নি ও ভবনের নিরাপত্তা সংক্রান্ত পরিদর্শনের তথ্য নিয়ে একটি প্রকাশ্য তথ্য ভান্ডার গড়ে তোলা ইত্যাদি।