ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সেবার মানোন্নয়নে জনবল, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং ব্যবস্থাপনার গুনগত পরিবর্তনের সুপারিশ টিআইবি’র
ঢাকা, ০৭ অক্টোবর ২০১৩: আজ এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা ব্যাপকভিত্তিক অগ্রগতি সত্বেও সুশাসনের বিবিধ ঘাটতির প্রেক্ষিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার গুনগত পরিবর্তনের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। আজ সকালে বিয়াম মিলনায়তনে ‘ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল: সুশাসনের অগ্রগতি, সমস্যা ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর এক ‘ফলোআপ ডায়গনস্টিক স্টাডি’র প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলা হয় জনবল বৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং ব্যবস্থাপনার গুনগত পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে দেশের তৃতীয় পর্যায়ের বৃহত্তম হাসপাতাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেকহা) এর সার্বিক মান আরো উন্নততর করার সুযোগ রয়েছে।
টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের সঞ্চালনায় গোলটেবিল আলোচনায় প্রধান অতিথি হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা: খন্দকার মো: সিফায়েত উল্লাহ এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোস্তাফিজুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। প্রতিবেদনের উপর আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন ঢামেকহার বার্ন ও সার্জারি ইউনিটের প্রধান সমন্বয়কারী ডা: সামন্ত লাল সেন এবং হেলথ রাইটস মুভমেন্ট ন্যাশনাল কমিটির সভাপতি ডা: রশীদ-ই-মাহবুব। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন টিআইবি’র উপ-নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা প্রতিবেনের সারাংশ উপস্থাপন করেন টিআইবি’র প্রোগ্রাম ম্যানেজার (রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি) তাসলিমা আক্তার।
প্রধান অতিথি তাঁর বক্তব্যে বলেন, স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দের ধারাবাহিক অপ্রতুলতার প্রেক্ষিতে সমন্বিত চিকিৎসা সেবা প্রদান দুরহ হলেও সীমিত সম্পদ নিয়ে ঢামেকহা জনগণকে নিরলস সেবা প্রদান করে চলছে।
বিশেষ অতিথি তাঁর বক্তব্যে বলেন, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও প্রচলিত আইনের সীমাবদ্ধতার কারণে হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা বিঘ্নিত হচ্ছে। চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট দক্ষ সহায়ক কর্মীর স্বল্পতার কারণে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পক্ষে কাঙ্খিত সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
অন্যতম আলোচক ডাঃ সামন্ত লাল সেন বলেন, হাসপাতালের ক্রয় ব্যবস্থাপনায় স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষকে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে দুর্নীতি অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
ডা: রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, দুর্বৃত্তায়ন দমন করা সম্ভব হলে সরকারি হাসপাতালের সেবার মান বৃদ্ধি পাবে।
বারডেম হাসপাতালের মহাপরিচালক ডা: নাজমুন নাহার বলেন স্বায়ত্বশাসন ব্যতীত সরকারি হাসপাতালগুলোতে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
ঢামেকহা-তে সুশাসনের প্রধান যে ৭টি কারণ প্রতিবেদনে চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো হল: দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা না থাকা, স্বচ্ছতার অভাব, দীর্ঘসূত্রিতা, তদারকির অভাব, জবাবদিহিতা ও মূল্যায়নের অভাব, কর্মচারীদের বদলীর ব্যবস্থা না থাকা এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত তথ্য কর্মকর্তার অনুপস্থিত। এসবের ফলে অপর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং প্রয়োজনীয় ও দক্ষ জনবল দিয়ে হাসপাতাল পরিচালনা করায় জনগণ সার্বিক ও পর্যাপ্তমানের চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং রোগীদের আর্থিক ক্ষতি বৃদ্ধি পেয়েছে। নিয়োগে প্রভাব ও আর্থিক অনিয়ম, ঔষধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম চুরি এবং বিভিন্ন সেবায় নিয়ম বহির্ভূত অর্থ আদায়ের ঘটনায় ঢামেকহায় দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ঘটেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী প্রতি ৬ জন ডাক্তারের বিপরীতে হাসপাতাল সংলগ্ন ডরমেটরী রয়েছে মাত্র একটি। ফ্ল্যাট অনুপাতে তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৪গুণ এবং মাত্র ২০ জন বাবুর্চী দিয়ে হাসপাতালের ২৫০ রোগীর তিনবেলার খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। উল্লেখ্য তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর সাম্প্রতিক নিয়োগের সময় ঘুষের বিনিময়ে নিয়োগের এবং সরকার নির্ধারিত জেলা, প্রতিবন্ধী ও মুক্তিযোদ্ধা কোটার নীতিমালা ভঙ্গের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
হাসপাতাল প্রদত্ত সেবার বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয় ডাক্তারের কক্ষে ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধির যখন খুশি উপস্থিতি, নির্দিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে পরীক্ষার পরামর্শ, বাজার দরের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ দরপত্র গ্রহণ, বিল পরিশোধে ঠিকাদার কর্তৃক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ঘুষ প্রদান, ঔষধ ও চিকিৎসা সামগ্রী সরিয়ে রাখা ছাড়াও বিভিন্নভাবে সেবাগ্রহিতাদেরকে নিয়ম বহির্ভূত অর্থ প্রদান করতে হয় যার পরিমাণ বিভিন্ন সেবা ভেদে ২০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত।
ঢামেকহা এর বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ উত্তরণে টিআইবি’র প্রতিবেদনে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের জন্য ১২টি এবং নীতি পর্যায়ের জন্য ১০টি সুপারিশ পেশ করে রোগী অনুপাতে ডাক্তার, নার্স ও কর্মচারী বণ্টন, সেবা সম্পর্কিত প্রচারণা, অভিযোগ নিষ্পত্তি কমিটি গঠন, হাসপাতালে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা স্থাপনসহ হাসপাতালের আয়ের ২৫ শতাংশ ব্যয়ের ক্ষমতা পরিচালককে প্রদান এবং আগামী ৩০ বছরের জনবলের চাহিদা, নিয়োগ, পদোন্নতি, অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি, আবাসন সুবিধা, বরাদ্দ প্রভৃতির বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্বারোপ করা হয়।